• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

চাকা ঘুরল স্বপ্নের মেট্রোরেলের

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২১  

ভায়াডাক্ট নামে পরিচিত উড়ালপথে বসানো রেললাইনে চলতে শুরু করেছে মেট্রোরেলের বিদ্যুৎ চালিত ট্রেন। গতকাল রোববার উত্তরার দিয়াবাড়ীর ডিপো থেকে পল্লবী স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে শুরু হয়েছে এর 'পারফরম্যান্স টেস্ট'। আগামী ১৫ মাস চলবে আরও পরীক্ষা ও প্রস্তুতি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যাত্রী চড়বে স্বপ্নের মেট্রোরেলে।

ভায়াডাক্টে গত শুক্রবারও ট্রেন চলেছিল। জাপান থেকে গত এপ্রিলে ঢাকায় আনা ট্রেন সেটটি ডিপোর ভেতর প্রথম চলে ১১ মে। তবে সেগুলো ছিল পারফরম্যান্স টেস্টের প্রস্তুতি। গতকালের চলাচলকেই 'পারফরম্যান্স টেস্ট' তথা চলাচল পরীক্ষণের শুভসূচনা বলছে কর্তৃপক্ষ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সবুজ পতাকা উড়িয়ে ট্রেনটির চলাচল উদ্বোধন করেন।

সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটে ডিপো থেকে যাত্রা করে জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশির জয়েন্ট ভেঞ্চারে (যৌথ উদ্যোগ) নির্মিত মেট্রোরেলের ট্রেন সেট। উত্তরা উত্তর, উত্তরা কেন্দ্র, উত্তরা দক্ষিণ ও পল্লবী স্টেশন ঘুরে ঠিক এক ঘণ্টা পর ডিপোতে ফিরে আসে সেটি। কখনও ২৫ কিলোমিটার গতিতে, কখনও পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলে দেড় হাজার ভোল্ট বিদ্যুৎ চালিত এই ট্রেন। পারফরম্যান্স টেস্টে যাত্রী ছিল না। জাপানি সরবরাহকারকের চালক ট্রেনটি পরিচালনা করেন।

'চলাচল পরীক্ষণের' উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী বছরেই মেট্রোরেলের কমপক্ষে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালু হবে। তার আগে ২০২২ সালের জুনে পদ্মা সেতু ও সেপ্টেম্বরে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। সব সমালোচনা ও ষড়যন্ত্রের জবাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মাধ্যমে দেওয়া হবে।

দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণাধীন ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেট্রো রেলপথের (এমআরটি-৬) বিজয় সরণি পর্যন্ত ভায়াডাক্ট নির্মিত হয়েছে। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রায় ৬৯ শতাংশ। দিয়াবাড়ী-আগারগাঁও অংশের অগ্রগতি প্রায় ৮৯ শতাংশ।

মেট্রোরেলে যাত্রী পরিবহনে কেন আরও ১৫ মাস লাগবে- এ প্রশ্নে নির্মাণকারী সরকারি সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, পারফরম্যান্স টেস্ট সার্বিকভাবে শেষ হতে ছয় মাস লাগতে পারে। এরপর হবে 'ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট'। তাতে লাগবে তিন মাস। এরপর হবে 'যাত্রীবিহীন ট্রায়াল রান'। এতে লাগবে পাঁচ মাস। ট্রেনকে যাত্রী পরিবহনের পর্যায়ে নিতেই এ সময় লাগবে।

এমআরটি-৬ রুটে পাঁচ সেট ট্রেন চলবে। গত এপ্রিলে প্রথম সেট, জুনে দ্বিতীয় সেট এবং ১৮ আগস্ট তৃতীয় ও চতুর্থ সেট ঢাকায় এসেছে। আগামী মাসে শেষ সেট আসবে। প্রতিটি ট্রেনকেই 'ফাংশনাল', 'পারফরম্যান্স' ও 'ইন্টিগ্রেটেড' টেস্টের ধাপ পেরিয়ে ট্রায়াল রানে যেতে হবে। ট্রেন ও রেলপথ নিরাপদ প্রমাণিত হওয়ার পর যাত্রী পরিবহন শুরু করবে। আগামী ১৫ মাস এসব প্রস্তুতি ও পরীক্ষা চলবে। এম এ এন ছিদ্দিক জানিয়েছেন, 'ফাংশনাল টেস্ট'-এ ১৯ রকম পরীক্ষা করা হয়। প্রথম দুই সেট ট্রেনের ফাংশনাল টেস্ট শেষ হয়েছে।

প্রতি ট্রেন সেটে ছয়টি করে বগি রয়েছে। দুই প্রান্তের দুই বগিতে ইঞ্জিন রয়েছে। বগিগুলো ডিপোতে যুক্ত করে ট্রেনের আকার দেওয়া হয়। তারপর এর ১৯ রকম খুঁটিনাটি পরীক্ষা হয়। এরপর তা রেললাইনে চালিয়ে দেখা হয়।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রস্তুতির বিষয়ে এমআরটি-৬ প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক সাইদুর রহমানের (ইলেকট্রিক অ্যান্ড মেকানিক্যাল এবং রোলিং স্টোক) কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, মেট্রোরেল একটি জটিল কারিগরি ব্যবস্থা। এ বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তবে প্রকল্প কর্মকর্তারা বলেছেন, ট্রেন, রেলপথ ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সমন্বিত ব্যবস্থাপনার প্রতিটি কম্পোনেন্ট ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা, তা যাচাই করে দেখাকে 'পারফরম্যান্স টেস্ট' বলে। 'ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট'-এ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করছে কিনা যাচাই করা হয়। যেমন, স্টেশনে ট্রেনটি যখন থামার কথা তখন থামছে কিনা, ঠিকঠাক দরজা খুলছে কিনা এসব নানা ধরনের ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয় সমন্বয় করা হয়।

এমআরটি-৬ ছাড়াও ঢাকায় আরও চারটি মেট্রোরেলপথ নির্মাণ করা হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। এমআরটি-৫ উত্তর এবং দক্ষিণ অংশে বিভক্ত। এসব পথে চলতে জাপান থেকে ২৪ সেট ট্রেন তিন হাজার ২০৮ কোটি ৪২ লাখ টাকায় কেনা হচ্ছে। এতে শুল্ক্ক, ভ্যাটসহ খরচ হবে চার হাজার ২৫৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। প্রতিটি ট্রেনের দাম পড়ছে ১৭৮ কোটি। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ট্রেনগুলোর মাঝের চার বগি একসঙ্গে ৩৯০ জন করে যাত্রী নিতে পারবে। দু'পাশের দুই ট্রেলার বগি ৩৭৪ জন করে যাত্রী নিতে পারবে। সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩০৮ জন যাত্রী উঠতে পারবে প্রতি সেটে।

প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকায় নির্মাণাধীন এমআরটি-৬ রুটে স্টেশন থাকছে ১৬টি। উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে ২০ দশমিক এক কিলোমিটার দূরের মতিঝিল স্টেশনে ৩৮ মিনিটে যাবে মেট্রোরেল। মেট্রোরেলের ট্রেন ও রেলপথ ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার গতির উপযোগী। তবে ঢাকায় মেট্রোরেল চলবে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে। শুরুর এবং শেষের দুই স্টেশনের মাঝে ১৪টি স্টেশনে এক মিনিট করে যাত্রাবিরতি করবে এ ট্রেন। সাত স্টেশনের আগে-পরে গতি কমাতে ও বাড়াতে সাত মিনিট সময় যাবে। পথের মাঝে বাঁকে গতি কমানোর কারণে তিন মিনিট সময় যাবে। রানিং টাইম ১২ মিনিট। বাকি দুই মিনিট বাড়তি রাখা হয়েছে। তবে প্রকল্প-সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, এ হিসাব এখনও চূড়ান্ত নয়।

প্রতি কিলোমিটারে দুই টাকা ৪০ পয়সা হিসাবে উত্তরা নর্থ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪৮ টাকা ভাড়া প্রস্তাব করেছে এ-সংক্রান্ত কমিটি। তবে এ অঙ্কও চূড়ান্ত নয়। যাত্রীর সংখ্যা হিসাবে তা কমবেশি হতে পারে। এমআরটি-৬ লাইন তৈরিতে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। যাত্রীদের ভাড়ার টাকা থেকে সংস্থাটির ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আগামী ৩০ বছরে প্রতি মাসে ৪৬ কোটি ১৬ লাখ ৫৪ হাজার করে ঋণের কিস্তি দিতে হবে। সরকারের দেওয়া পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা অর্থায়ন বাবদ মাসে ১৪ লাখ ৯৭ লাখ কিস্তি পরিশোধ করতে হবে।

এমআরটি-৬ ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। পিক আওয়ারে প্রতি সাড়ে তিন মিনিট বিরতিতে ট্রেন চলবে। ২০৩০ সাল নাগাদ এ রুটে দৈনিক ছয় লাখ ৭৭ হাজার ৩০০ যাত্রী চলতে পারবে। মেট্রোর ট্রেনের ছয় বগির একটি নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ট্রেনে বিদ্যুৎ সরবরাহে দিয়াবাড়ী ও মতিঝিলে দুটি রিসিভিং সাবস্টেশন (আরএসএস) থাকবে। জাতীয় গ্রিড থেকে কোনো কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ বা ব্যাহত হলে ট্রেনের ব্যাটারিতে সঞ্চিত বিদ্যুতেই এটি পরবর্তী স্টেশন পর্যন্ত চলবে। মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো তিনতলা। দ্বিতীয়তলা দিয়ে রাস্তা পারপার হওয়া যাবে। ট্রেন ছাড়বে তৃতীয়তলার প্ল্যাটফর্ম থেকে। স্টেশনে থাকবে খাবারসহ নানা বাণিজ্যিক সুবিধা। পাঁচটি স্টেশনে হবে প্লাজা।

এমআরটি-৬ প্রকল্পটি ২০১২ সালে অনুমোদন পেলেও কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুনে আগারগাঁও পর্যন্ত এবং ২০২৪ সালের জুনে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশে দিয়েছেন এমআরটি-৬ মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করতে। ওবায়দুল কাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানান, বর্ধিতকরণের কাজ চলছে।

অনুষ্ঠানে জাপান দূতাবাসের মিনিস্টার অ্যান্ড ডেপুটি চিফ অব দ্য মিশন হিরোইওকি ইয়ামায়া, জাইকার বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান প্রতিনিধি ইহুও হায়েকাওয়া, ডিএমটিসিএলের এমএএন ছিদ্দিক, প্রকল্প পরিচালক আফতাবউদ্দিন তালুকদারসহ পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। চলাচল শুরুর আগে ওবায়দুল কাদের ও কর্মকর্তারা ট্রেনের অভ্যন্তরে ঘুরে দেখেন।

সড়কের মাঝ বরাবর নির্মিত উড়ালপথের ওপর ট্রেনের চলাচল দেখতে সাধারণ মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। দিয়াবাড়ীতে লাইনের আশপাশে বাড়িঘর নেই। তবে মিরপুরে উঁচু ভবনের ছাদ ও জানালা থেকে হাজারো উৎসুক মানুষ দেখেন স্বপ্নের ট্রেনের চলাচল।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা