• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

কচুয়ার পাঁচ নারীর সংগ্রামী জীবন

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ৫ জুন ২০২৩  

বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার জীবনযুদ্ধে জয়ী পাঁচ সংগ্রামী নারীকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা দিয়েছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। সমাজের নানা প্রতিকুলতা ও নির্যাতন পেরিয়ে তারা সফলতা অর্জন করেছেন। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান জানান, জীবন সংগ্রামে টিকে থেকে সফল হওয়া পাঁজন নারীকে সরকার প্রতিবছর সম্মান জনক এই পদক দেয়। তাদের সংগ্রামী জীবনের গল্প হৃদয়স্পর্শী ও শিক্ষণীয়। জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় এই কার্যক্রম চলে। 
(১) অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী:
নানা প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করেন আমিনা আক্তার। তিনি কচুয়া উপজেলা সদরের মো. ইয়াছিন আরাফাতের স্ত্রী। তার এই সফলতার জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাঁকে সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা-২০২২ পদক প্রদান করেছে।আমিনা আক্তার মিনা জানান, তার ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়। তার স্বামী তখন বেকার। বিয়ের কিছুদিন পর আার্থিক সংকট দেখা দেয়। মিনা দর্জির কাজ শুরু করেন। শ্বাশুড়ি তাতে বাধা দেয়। এরপর বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিশুদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। তাতেও শ্বাশুড়ি নিষেধ করেন। অবশেষে বাবার দেয়া গহনা বিক্রি করে কম্পিউটার কিনে কম্পোজের কাজ শুরু করেন। তার আয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। তখন সে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ শিখে বাড়ি ফিরে একটি দোকান দেন। ২০১২ সালে স্বামীর দুর্ঘটনায় ব্যবসা বন্ধ করতে হয়। কিছুদিন পর আবার হাঁস মুরগী, কোয়েল পাখি পালন ব্যবসা শুরু করেন। তাতেও শ্বাশুড়ি, ননদ বাধা দেয়। এরপর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আইজিএ প্রশিক্ষণে ব্লক- বাটিকের কাজ শিখে ব্যবসা শুরু করেন। এতে তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে ওঠেন। নিজের আয়ে নিজের জমিতে একটি বসতবাড়ী করেন। তিনি অসহায় নারীদের সাবলম্বী হতে সহায়তা করছেন। 
(২) শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সফল নারী: 
কচুয়ার টেংরাখালী ইউনিয়নের টেংরাখালী গ্রামের শিকদার মো. মাসুমের স্ত্রী আনজুমানারা খাতুন। দরিদ্রতা তার লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছাকে ঠেকাতে পারেনি। শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সফল নারী হওয়ায় তার সংগ্রামী জীবনকে সম্মান জানাতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাঁকে সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা-২০২২ পদক প্রদান করেছে। আনজুমানারা খাতুন জানান, এইচএসসি পাশের পর দরিদ্র মা-বাবা তাকে বিয়ে দেয়। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামীর পরিবারেও আর্থিক অনটন দেখা দেয়। এই অভাব মেটাতে তিনি দর্জি কাজ, প্রাইভেট পড়ানো, প্রাইভেট স্কুলে কাজ করেন। এর পাশাপাশি নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে যান। সমাজের নানা বাধা পেরিয়ে তিনি বিএ পাশ করেন। এরপর আন্ধারমানিক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সংসারের হাল ধরে যখন সবাইকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন, তখন তার স্বামী এবং  সন্তানের কিডনি রোগ ধরা পড়ে। এদিকে নিজেও হার্র্টের রোগী। তবু তিনি জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার-২০২২ সম্মাননা পেয়ে তিনি খুব আনন্দিত হয়ে বলেন, ‘নবজীবন পেলাম। সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’ 
(৩) সফল জননী:
কল্পনা রানী বসু কচুয়া সদর উপজেলার প্রয়াত দেবু প্রসাদ বসুর স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি দুই সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। তবু মনোবল হারাননি। নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও তিনি সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করেছেন। এজন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাঁকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা--২০২২ প্রদান করেছে।  কল্পনা রানী বসু জানান, বিবাহিত জীবনে ১৬ বছর পর্যন্ত তিনি স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন। নিজস্ব তেমন কোন জায়গা জমি ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। দুই সন্তানকে লেখাপড়া শেখানো ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নানা কাজে সীমাহীন পরিশ্রম করেন। তার মেয়ে তুপা বসু বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার এবং বর্তমানে সাব-রেজিষ্ট্রার হিসেবে কচুয়া উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছেন। ছেলে পল্লব বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাষ্টার্স এবং বিসিএস ৪০তম ব্যাচ (শিক্ষা ক্যাডার)।
(৪) নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যমে জীবন শুরুকারী নারী :
পারিবারিক নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরুকারী নারী আজিজুন নেছা। এমন সাহসী জীবন সংগ্রামের জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সম্প্রতি তাকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা-২০২২ পদক দিয়েছে। তিনি কচুয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের মৃত শেখ মোজাহারুল ইসলাম ও কামরুন্নেছা বেগমের মেয়ে।আজিজুন নেছা জানান, এসএসসিতে লেখাপড়া কালে তার বিয়ে হয়। প্রথম সন্তান গর্ভে আসলে স্বামী তাকে গোপনে গর্ভপাত করান। এরপরে আর সন্তান না হওয়ায় স্বামী, ননদ ও শশুর-শাশুরীর অত্যাচার শুরু করে। তার স্বামী পরনারী আসক্ত হয়ে পড়ে। এরি মধ্যে একটি কন্যাসন্তান হয়। পরনারী আসক্তির ব্যাপারে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে নালিশ জানিয়ে বিপদ বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে স্বামীর বাড়ী থেকে বাবার বাড়ি চলে আসেন। নানা কাজ করে অবশেষে একটি কসমেটিকস দোকান দেন। তাই দিয়ে মেয়ের পড়ালেখাসহ সকল চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে ভাল আছেন। তার মেয়ে ঢাকা ইসলামি আরবি বিশ^বিদ্যালয়ে বিবিএ অনার্স পড়ছে। 
(৫) সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানকারী নারী:
কচুয়া উপজেলার মসনী গ্রামের গোপীনাথ দাসের স্ত্রী বনলতা রানী দাস সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখছেন। এজন্য তাঁকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা- ২০২২ পদক দিয়েছে।বনলতা রানী দাস জানান, তিনি ১৫ টির বেশী বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করেছেন। কচুয়া উপজেলার বাধাল ইউনিয়নে ২০২১ এবং ২০১৬ সালে তিনি মহিলা ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়াও তিনি বাধাল ইউনিয়নের মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি। ব্রাকের মাধ্যমে নারীদের আইনগত সহায়তা দেন। এলাকার গর্ভবতী মায়েদের সেবাদান, গরিব অসহায় মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি দেয়া, কর্মঠ নারীদের হাঁস-মুরগী প্রতিপালনের মাধ্যমে স্বাবলম্বীর ব্যবস্থা করা সহ নানাভাবে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছেন। নানা বিষয়ে নিয়মিত সচেতনতা মুলক সভা করেন।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা