• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

ইখলাস বিহীন আমল মূল্যহীন

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০  

মুসলমান হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের ওপর স্রষ্টার হক রয়েছে। ফরজ-ওয়াজিব থেকে শুরু করে সাধারণ নফল কিংবা দু-এক টাকা দান-খয়রাতসহ সব কিছুই এ হক আদায়ের আওতাভুক্ত।

সামগ্রিক অর্থে এ সবগুলোকে আমরা ইবাদত বলে থাকি। প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন রকমের ইবাদত করি, জীবন যাপনে মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করি। এ ইবাদত পালন কিংবা বিধি-বিধান মেনে চলার যেটুকু প্রচেষ্টা আমরা আমাদের সাধ্যমতো চালিয়ে যাচ্ছি, এর হিসাব-নিকাশ জমা হচ্ছে অপার্থিব আমলনামায়। কিন্তু এ জমা হওয়া কিসের ভিত্তিতে? সংখ্যাধিক্য নাকি গুণগত মান অথবা অন্যকিছু? ব্যস্ত জীবনে যেখানে ইবাদতের অবসর দিন দিন কমে আসছে, সেখানে কবুল হওয়া-না হওয়া নিয়ে ভাববার সময় ও সচেতনতাও হারিয়ে ফেলছি আমাদের অজান্তে। অথচ এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের, সবচেয়ে বেশি বিবেচনার এবং সচেতনতার দাবি রাখে।

কুরআন ও হাদিস থেকে প্রমাণিত সত্য হল-ইখলাস সব আমলের গ্রহণযোগ্যতার প্রথম শর্ত। ইখলাস বিহীন কোনো কিছুই আসমানি দরবারে কবুলযোগ্য নয়। বরং কখনো এমন আমল বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পার্থিব মোহ ও সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণের যাবতীয় লোভ থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহ পাকের জন্য সমর্পিত আত্মার সামান্য আমলও ইখলাসের কারণে অনেক বেশি মূল্যবান। চারিদিকে সৌজন্যের ছড়াছড়ির এমন অস্থির সময়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি সাধারণ উদাসীনতা আমাদের সবার জন্য বড়ই বেমানান।

খুব সংক্ষেপে এটাই ইখলাসের প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে প্রচুর আয়াত ও হাদিস রয়েছে। পবিত্র কুরআনে সূরা বাইয়েনাতের ৫ নম্বর আয়াত, সূরা যুমারের ২ ও ১১ নং আয়াতসহ আরও নানা জায়গায় আল্লাহ পাক আমাদের ইখলাসের সঙ্গে একনিষ্ঠ হয়ে ইবাদতে মগ্ন হওয়ার জন্য আদেশ করেছেন। আর শিশুদের মক্তব থেকে শুরু করে বুখারি শরিফ পর্যন্ত যে হাদিসটি আমরা অহরহ শুনছি- সেখানেও বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই প্রতিটি আমল বা কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহ পাকের কাছে আমাদের যাবতীয় আমল গৃহীত হওয়ার ক্ষেত্রে বাহ্যিক কোনো রঙ-ঢঙ কিংবা কোনো পার্থিব বিবেচনা যে উদ্দেশ্য নয়, তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রাসুল  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ পাক তোমাদের শরীর এবং আকৃতির দিকে লক্ষ্য করেন না। বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও আমলের প্রতি দৃষ্টি দেন। (বুখারি ও মুসলিম)

ইখলাসের সজ্ঞা দিতে গিয়ে হজরত আবু উসমান বলেছেন, নিজের প্রতি মহান আল্লাহর সার্বক্ষণিক দৃষ্টির কথা স্মরণ রেখে সৃষ্টজীবের সমুদয় কৃত্রিমতা ভুলে যাওয়ার নাম ইখলাস।

ইখলাসের ব্যাপারে আরও সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিখ্যাত বুযুর্গ ফুজাইল। তিনি বলেন, মানুষের কারণে আমল ছেড়ে দেওয়ার নাম- রিয়া, আর মানুষের জন্য আমল করার নাম-শিরক। কিন্তু এ দু’টো থেকে রেহাই পাওয়ার নামই হচ্ছে- ইখলাস।

বুযুর্গরা বলেন, অনেক ছোট কাজ নিয়তের কারণে মহান আল্লাহ পাকের দরবারে অতিশয় মূল্যবান ও দামি হয়ে যায়। আবার অনেক বড় কাজ নিয়তের ত্রুটির কারণে তুচ্ছ হয়ে যায়। হজরত বিশর হাফি বলতেন, মানুষের মধ্যে প্রসিদ্ধ হওয়ার জন্য যে আমল করে, সে সত্যিকার অর্থে আল্লাহকে ভয় করে না।

প্রখ্যাত বুযুর্গ মারুফ কারখি নিজেকে আঘাত করে সজাগ করতেন এবং বলতেন, ইখলাসের ব্যাপারে সতর্ক থাকো, মুক্তি মিলবে হয়তো।

হজরত ইয়াকুব আল মাকফুফ বলেছেন, একজন মুখলিস আমলদার মুমিন তার নেক কাজগুলো এমনভাবে গোপন রাখে যেভাবে সে তার কৃত পাপ কাজসমূহ লুকিয়ে রাখে।

বিশিষ্ট সাহাবি হজরত তামীম দারিকে কেউ জিজ্ঞেস করলো, আপনি প্রতি রাতে কতো রাকাত নামাজ আদায় করেন? এমন প্রশ্ন শুনে তিনি খুব রেগে গেলেন এবং বললেন, আল্লাহর কসম, রাতের অন্ধকারে গোপনে এক রাকাত নামাজ পড়া আমার কাছে; এমন সারারাত নামাজের চেয়ে অনেক উত্তম- যা রাত পোহালে মানুষকে জানানো হয়।

নিজের ছোট-বড় নেক আমল মানুষের কাছে প্রচার না করে গোপন রাখার তাগিদ দিয়ে সাহাবি হজরত ইবনে মাসউদ বলেছেন, পৃথিবী বাসীর কাছে নিজেদের পূণ্য কর্মগুলো গোপন রাখো, এখানে পরিচিত ও সমাদৃত না হয়ে তোমরা আকাশজগতে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখো।

হজরত মুহাম্মদ বিন ওয়াসে তার শিষ্যদের বলতেন, গোনাহ ও পাপের যদি কোনো দুর্গন্ধ থাকতো, তবে আমার কৃত পাপাচারের দুর্গন্ধে তোমরা কেউ আমার কাছেই আসতে পারতে না।

আমাদের পূর্বসুরি আল্লাহওয়ালারা এভাবেই নিজেদের সাধনা ও ইবাদতকে লোকসমাজ থেকে লুকিয়ে রাখতেন। যা কিছু ভালো ও পূণ্য তারা করতেন; তা কেবল আল্লাহ পাকের জন্যই করতেন। সমাজ ও মানুষের সব প্রশংসা ও বাহবা থেকে মোহমুক্ত হয়ে তারা নিমগ্ন হতেন ইখলাসযুক্ত জিকির-ইবাদতে।

পরম দয়াময়ের আশ্রয়ে এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার অপার্থিব স্বাদ ও আনন্দ যে পেয়েছে- তার কাছে এ চাকচিক্যভরা রঙিন জগত নিতান্তই তুচ্ছ হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন নানা রকমের ইবাদত করেও আমাদের হৃদয়ভরা যে পার্থিব প্রেম ও আসক্তি; তাতে আমাদের মধ্যে ইখলাসের অভাব প্রকটভাবে ধরা পড়ে।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা