• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৬ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

ইসলামের আলোকে স্বপ্ন ও এর ব্যাখ্যা

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ১৭ জুন ২০২০  

হজরত আবু হোরায়রা (রাদি.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নবুওয়াতের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটেছে। মুবাশ্শিরাত ছাড়া নবুওয়াতের আর কোনো অংশ বাকি নেই। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, মুবাশ্শিরাত কি জিনিস? (মুবাশ্শিরাত অর্থ: সুসংবাদ দানকারী জিনিস)। উত্তরে রাসূল (সা.) বলেন, সত্য স্বপ্ন। (সহিহ বুখারি, মুসনাদে আহমদ, মুওয়াত্তা মালেক)।

আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মুবাশ্শিরাত হয় এবং এটি নবুওয়াতের একটি অংশ। অন্য এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুমিনের স্বপ্ন নবুওয়াতের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে তিরমিজি, সুনানে আবু দাউদ)।

সত্য স্বপ্ন নবুওয়াতের অংশ:

উপরিউক্ত হাদিসের অর্থ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যখন নবুওয়াত লাভের সময় হয়, প্রথমদিকে ছয় মাস পর্যন্ত কোনো ওহি অবতীর্ণ হয়নি। এ সময় তিনি শুধু সত্য স্বপ্ন দেখতেন। হাদিস শরিফে আছে, এ সময় রাসূল (সা.) স্বপ্নে যে ঘটনাটি দেখতেন, জাগ্রত হওয়ার পর হুবহু সে ঘটনা ঘটতে দেখতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বপ্ন সত্যে পরিণত হত এবং তার সত্যতা দিনের আলোর মতো সবার সামনে পরিষ্কার প্রতিভাত হত। ছ’মাস পর ওহির ধারাবাহিকতা শুরু হয়। (সহিহ বুখারি)।

নবুওয়াত লাভের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে তেইশ বছর ছিলেন। এই তেইশ বছরের মধ্যে প্রথম ছয়মাস শুধু সত্য স্বপ্নের সময় ছিল। তেইশকে দুই দিয়ে গুণ দিলে ছিচল্লিশ হয়। এই কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সত্যস্বপ্ন নবুওয়াতের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সময়কালকে ছিচল্লিশ ভাগ করা হলে তন্মধ্যে এক ভাগে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে কোনো ওহি আসেনি বরং এ সময় তিনি শুধু সত্য স্বপ্ন দেখতেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুমিনের স্বপ্ন নবুওয়াতের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। এ কথা বলে এই দিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, আমার ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সত্য স্বপ্নের ধারাবাহিকতা আমার পরও বাকি থাকবে। এর মাধ্যমে মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয়া হবে। অন্য এক হাদিসে আছে, শেষ যুগে কেয়ামতের পূর্বে মুসলমানদের অধিকাংশ স্বপ্নই সত্য হবে। (সহিহ বুখারি)।

এ থেকে বুঝা যায়, স্বপ্নও আল্লাহ তায়ালার একটি নেয়ামত। এর মাধ্যমে মানুষ সুসংবাদ লাভ করে। তাই স্বপ্নের মাধ্যমে কোনো সুসংবাদ প্রাপ্ত হলে তার জন্য আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করবে।

স্বপ্নের ব্যাপারে দু’টি মত:

আমাদের সমাজে স্বপ্ন নিয়ে বাড়াবাড়ি আছে। কিছু লোক স্বপ্ন সত্য হতে পারে বলে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এটি ভুল। কারণ একটু পূর্বেই আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সত্যস্বপ্ন নবুওয়াতের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। রাসূল (সা.) বলেছেন যে, সত্যস্বপ্ন সুসংবাদদানকারী। অন্যদিকে কিছু লোক আছে, যারা স্বপ্নের পেছনে পড়ে থাকে। স্বপ্নকেই মুক্তি ও ফজিলতের বিষয় মনে করে। যদি কেউ ভালো স্বপ্ন দেখে, ব্যস! তার ভক্ত হয়ে যায়। কেউ যদি নিজের সম্পর্কে ভালো স্বপ্ন দেখে তা হলে সে নিজেই নিজের সম্পর্কে বিশেষ সুধারণা পোষণ করে যে, আমি তো বুজুর্গ হয়ে গেছি।

স্বপ্ন সাধারণত নিদ্রা অবস্থায় হয়। তবে আল্লাহ তায়ালা অনেক সময় জাগ্রত অবস্থায়ও কিছু কিছু জিনিস দেখান, যাকে বলা হয় কাশফ। কারো যদি কাশফ হয় তাহলে লোকেরা তাকে অনেক বড় বুজুর্গ মনে করে। সেটা সুন্নতের মোতাবেক না হলেও। বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য যে, মানুষের সম্মানের ভিত্তি স্বপ্ন বা কাশফ না। বরং আসল মানদণ্ড হলো তার সচেতন জিন্দেগি। জাগ্রত অবস্থায় সে কি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে? জাগ্রত অবস্থায় সে কি আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করে? যদি আনুগত্য না করে তা হলে সে হাজার স্বপ্ন দেখলেও, তার হাজার কাশফ হলেও, হাজার কারামত তার হাতে প্রকাশ পেলেও, সেগুলো মর্যাদা ও সম্মানের মাপকাঠি না। আজকাল এ বিষয়ে মারাত্মক গোমরাহি ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পির-মুরিদিয়োর সঙ্গে একে বাধ্যতামূলক মনে করা হচ্ছে। সর্বদা মানুষ স্বপ্ন, কাশফ ও কারামতের পেছনে পড়ে আছে।

শরীয়তের দৃষ্টিতে স্বপ্নের গুরুত্ব:

হজরত মোহাম্মদ ইবনে সিরিন (রহ.) একজন উঁচু স্তরের তাবেয়ি ছিলেন। স্বপ্নের ব্যাখ্যাদানে তিনি ছিলেন ইমাম। পুরা উম্মতের মধ্যে স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যাদানে তারচেয়ে বড় আলেম সম্ভবত আর কেউ জন্ম নেয়নি। আল্লাহ তায়ালা তাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যাদানে এক বিশেষ যোগ্যতা দান করেছিলেন। তার অনেক আশ্চর্য ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে। তবে তার খুব প্রিয় একটি বাক্য হলো, যদিও তা ছোট কিন্তু স্মরণ রাখার মতো। বাক্যটিতে স্বপ্নের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন,

الرؤيا تسر ولا تفر

স্বপ্ন মানুষকে আনন্দ দান করে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে খুব ভালো স্বপ্ন দেখিয়েছেন। কিন্তু তা কাউকে যেন ধোঁকায় না ফেলে। কেউ যেন মনে না করে আমি অনেক ঊর্ধে উঠে গেছি। ফলে জাগ্রত অবস্থার আমল থেকে সে উদাসীন হয়ে পড়ে।

হজেরত থানবি (রহ.) ও স্বপ্নের ব্যাখ্যা:

হজরত থানবি (রহ.) এর কাছে অনেক লোক স্বপ্নের তাবির জিজ্ঞাসা করত। উত্তরে তিনি সাধারণত একটি পঙ্ক্তিটি আবৃত্তি করতেন। ‘আমি রাতও না। রাতকে জিজ্ঞাসাকারীও না। আলাহ তায়ালা রেসালাতের সূর্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দান করেছেন। তাই আমি তাঁর কথা বলি।’

স্বপ্ন যত ভালো হোক, এর জন্য আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করো। হতে পারে সেটা সুসংবাদদানকারী। হয়তো আল্লাহ তায়ালা কোনো সময় এর বরকত দান করবেন। কিন্তু শুধু স্বপ্নের কারণে এই ফয়সালা করা উচিত না যে, তিনি অনেক বুজুর্গ বা তিনি অনেক সম্মানিত।

মুফতি শফি (রহ.) ও তার সুসংবাদবাহী স্বপ্ন:

হজরত মুফতি মোহাম্মদ শফি (রহ.) সম্পর্কে বিশজনের বেশি মানুষ স্বপ্ন দেখেছেন। যেমন, একব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শফি (রহ.) এর চেহারায় স্বপ্নে উপস্থিত হয়েছিলেন। এ ধরনের স্বপ্ন আরো অনেক ব্যক্তি দেখেছেন। লোকেরা যখন এ ধরনের চিঠি লিখে পাঠাত, তিনি চিঠিগুলোকে নিজের কাছে রেখে দিতেন এবং মুবাশ্শিরাত নামে একটি রেজিস্টার তৈরি করেছিলেন। চিঠির বক্তব্যগুলো সেখানে লিখে রাখতেন। সেই রেজিস্টারের শুরুতে তিনি একটি নোট লিখেছিলেন। তা হলো এই, ‘এ রেজিস্টারে যেসব স্বপ্নের কথা উদ্ধৃত করছি, আল্লাহ তায়ালার নেক বান্দারা আমার সম্পর্কে স্বপ্নগুলো দেখেছেন। উদ্ধৃত করার উদ্দেশ্য হলো এগুলো সুসংবাদবাহী স্বপ্ন ও শুভলক্ষণ। আল্লাহ তায়ালা এর বরকতে আমাকে ইসলাহ করুন। আমি বিশেষভাবে পাঠকদেরকে সতর্ক করছি যে, সামনের পৃষ্ঠাগুলোতে যেসব স্বপ্নের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, এগুলো কখনোই সম্মানের মাপকাঠি না। এগুলোকে সামনে রেখে আমার সম্পর্কে কোনো ফয়সালা যেন করা না হয়। বরং প্রকৃত মাপকাঠি হলো জাগ্রত অবস্থার কথা ও কাজ। সুতরাং উদ্ধৃত স্বপ্নগুলোর কারণে কেউ যেন ধোঁকায় না পড়ে।’

উনি কথাগুলো এ জন্যই লিখেছেন, যাতে চিঠির বক্তব্য পড়ে কেউ ধোঁকা না খায়। এটাই স্বপ্নের বাস্তবতা। সুতরাং যখন মানুষ ভালো স্বপ্ন দেখবে আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করবে। দোয়া করবে, হে আল্লাহ, আমার ব্যাপারে স্বপ্নগুলোকে আপনি বরকতময় বানিয়ে দিন। কিন্তু এর কারণে ধোঁকায় পড়বে না। অন্যের ব্যাপারেও না। নিজের ব্যাপারেও না। স্বপ্ন সম্পর্কে আরো দু-তিনটি হাদিস আছে। সেসম্পর্কে অধিকাংশ লোকই তেমন কিছু জানে না। এর ফলে তারা ভুলের শিকার হয়। নিম্নে হাদিসগুলো সম্পর্কে সামান্য আলোচনা রাখছি।

শয়তান স্বপ্নে রাসূল (সা.) এর সুরতে আসতে পারে না:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ, قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ, " مَنْ رَآنِي فِي الْمَنَامِ، فَقَدْ رَآنِي، فَإِنَّ الشَّيْطَانَ لَا يَتَمَثَّلُ بِي

হজরত আবু হোরায়রা (রাদি.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আমাকে স্বপ্নে দেখে, সে আমাকেই দেখে। কারণ শয়তান আমার সুরত ধারণ করতে পারে না।

যদি আল্লাহ তায়ালা কাউকে স্বপ্নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখার সৌভাগ্য দান করেন তাহলে এটা অনেক বড় সৌভাগ্য ও আনন্দের বিষয়।

হাদিসের অর্থ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের যে দৈহিক বর্ণনা হাদিসে এসেছে, কেউ যদি রাসূল (সা.)-কে সেই সুরতে দেখে তা হলে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই দেখেছে। শয়তান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা-সুরত ধারণ করে কাউকে ধোঁকা দিতে পারে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে স্বপ্নে দেখার এই বিশেষ আলামতটি বর্ণনা করেছেন।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা