• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

বাংলা ভাষার বিকৃতি দূষণ দেখবে কে

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯  

যথাযোগ্য ব্যবহার, চর্চা আর সর্বজনীনতার ওপর ভাষার সমৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভরশীল। সমৃদ্ধি না ঘটলে ভাষা দীন হতে থাকে, একসময় বিলুপ্তি ঘটে। পৃথিবীতে ভাষার মৃত্যু বা বিলুপ্তির এ রূপ অনেক উদাহরণ আছে। ভাষা দীন-দুর্বল হয়ে যাওয়ার নানাবিধ কারণও রয়েছে। এর মধ্যে আছে বিকৃতিসাধন, রূপান্তর, ভাষার ব্যবহারে অসচেতনতা, অপব্যবহার প্রভৃতি। বিশ্বায়ন, আকাশ সংস্কৃতি, ডিজিটাইজেশনের কারণে ইংরেজির অধিক ব্যবহারের প্রভাবে মাতৃভাষা প্রবহমানতা হারাচ্ছে। তার ওপর আছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসন।

আজকাল বেতার-টিভি চালু করলেই শোনা যায়-‘হ্যালো লিসেনার্স’, ‘হ্যালো ভিউয়ার্স’। তরুণদের মুখে মুখে ‘আবার জিগায়’, ‘খাইলেই দিলখোশ’, ‘এক্সট্রা খাতির’, ‘তোর বেইল নাই’ ইত্যাদি নানান ভাষার ব্যবহার। আবার নাটকের নামÑ ‘ডেট ফেল’, ‘লাভ ডটকম’, ‘হাউসফুল’, ‘বাংলা টিচার’, ‘হিরো আকরাম’ ‘ফুল ম্যাড’ ইত্যাদি বেশ আলোচিত।

তরুণ প্রজন্মের অনেকে যে ভাষা ব্যবহার করছে তা না-আঞ্চলিক, না-প্রমিত। তারা মামাকে ‘মাম্মা’; আবার বন্ধু, রিকশাওয়ালা ও বাসচালককেও মাম্মা বলে সম্বোধন করে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এভাবেই বাংলা ভাষার সঙ্গে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফারসির মিশ্রণ চলছে। আধুনিকতার দোহাই দিয়ে এ রকম নানা শব্দ ঢুকে বাংলা ভাষাকে দূষিত করছে, বিকৃত করছে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, নাটক বা চলচ্চিত্রে ‘জগাখিচুড়ি’ ভাষার ব্যবহার মূল ভাষায় প্রভাব ফেলছে। আবার বেতারে ‘জকি’ নামের আরেকটি চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। এই চরিত্র ভাষার বিকৃতিতে নজির দেখাচ্ছে। গণমাধ্যমের প্রভাবে তরুণরা প্রভাবিত হচ্ছে। ভাষা বিকৃতির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার। ফলে বিকৃতির প্রভাব দ্রুত ছড়াচ্ছে সর্বত্র। অথচ বাংলা ভাষার দূষণ ও বিকৃতি রোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে।

হাইকোর্টই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর আদেশ দেন ২০১৪ সালে। রয়েছে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭সহ সরকারি অনেক বিধিনিষেধ। কিন্তু ওইসব আদেশ, আইন ও বিধিনিষেধের বাস্তবায়ন নেই। সর্বত্র বাংলা ভাষার দূষণ চলছেই। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারের আদেশও উপেক্ষিত। বিষয়গুলো নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি, শিক্ষাবিদসহ নানা মহল উদ্বিগ্ন হলেও বিষয়টি দেখার কেউ নেই।

জানা যায়, ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের ‘ভাষা দূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শীর্ষক একটি লেখা প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়Ñ ‘ভাষার মাসে বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক চর্চা আমাদের ভাবায়। শুদ্ধবাদীরা শঙ্কিত হন, বাংলা ভাষা তার রূপ হারিয়ে কোনো শংকর ভাষায় রূপ নেয়, তা ভেবে।

অন্যদিকে শুদ্ধবাদীদের অবস্থানকে যারা রক্ষণশীল ও পরিবর্তনবিরোধী বলে চিহ্নিত করেন, তারা বলেনÑ এত ভাবাভাবির কী আছে, ভাষা চলবে ভাষার মতো। এর ব্যবহার-প্রয়োগে পরিবর্তন আসবে ভাষা ব্যবহারকারীদের প্রকাশের প্রয়োজনেই। দুপক্ষের ভাবনাতেই সত্য আছেÑ বাংলা ভাষা যে সত্যি সত্যি একটি মিশ্র ভাষা হয়ে যাচ্ছে এবং এর নানা স্থানচ্যুতি ঘটছে।’ ওই লেখায় আরও বলা হয়, ‘ভাষাকে নদীর সঙ্গে তুলনা করি; কিন্তু এই ভাষানদীকে আমরা যে দূষিত করছি প্রতিদিন, তা নিয়ে কি ভাবী?’ ওই লেখাটি আমলে নিয়ে তৎকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বেশ কয়েক দফা নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে রেডিও ও টেলিভিশনে ‘বিকৃত উচ্চারণে’ এবং ‘ভাষা ব্যঙ্গ’ করে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই আদেশে আদালত বলেন, বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষা করতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে। এই ভাষার প্রতি আর কোনো আঘাত যাতে না আসে, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। এ ছাড়া আদালত, বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা কথন, সঠিক শব্দ চয়ন না করা এবং বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারেÑ সে বিষয়ে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। ওই নির্দেশে ২০১২ সালের ২৮ মার্চ ভাষাদূষণ ও বিকৃতি রোধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি ৯ দফা সুপারিশও করে।

সুপারিশে বলা হয়, ভাষাদূষণ রোধে আইন তৈরি করে বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল এবং দেশি বেতার ও টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণ; বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রমিত বাংলা ভাষার একটি কোর্স চালু এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পঠন-পাঠন প্রবর্তনের উদ্যোগ; বেতার ও টেলিভিশনে প্রমিত বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত এবং ভাষায় বিদেশি শব্দের অকারণ মিশ্রণ দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাষার বিকার ও দূষণ রোধে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস রেগুলেটরি কমিশনের ব্যবস্থা গ্রহণ; বেতার ও টেলিভিশনে ভাষাদূষণ রোধ।

সুপারিশে আরও বলা হয়, প্রমিত বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে একটি স্থায়ী কমিটি গঠন করতে হবে। ওই কমিটি বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত অনুষ্ঠান পরিবীক্ষণ করে মতামত, উপদেশ ও নির্দেশ প্রদান করবে। মুদ্রণ ও অনলাইন মাধ্যমের ক্ষেত্রেও প্রমিত ভাষা ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ভাষাদূষণ রোধের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় অনুরূপ একটি কমিটি গঠন করতে পারে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডকে চলচ্চিত্রে ভাষাদূষণ রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনের কলার টিউনে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষার ব্যবহার নিরুৎসাহ করার এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

জানা যায়, বিশেষজ্ঞ কমিটির ওই সুপারিশ হাইকোর্টে ফাইলবন্দি অবস্থায় আছে। হাইকোর্টের যে বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ দিয়েছিলেন, সেই বেঞ্চ বিলুপ্ত হওয়ায় ওই সুয়োমোটো মামলাটির আর শুনানি হচ্ছে না। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন নেই : রাজধানীর পান্থপথ, শাহবাগসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে স্থাপন করা হয়েছে বড় বড় বিলবোর্ড। এসব বিলবোর্ডের ভাষায় রয়েছে ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণ। অথচ এক রিটে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট ও বিভিন্ন দপ্তরের নামফলকে বাংলা ব্যবহার করতে বলা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্টের বোর্ডগুলোকে আদেশটি কার্যকর করতে বলে। কিন্তু এর পর আর দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন : ভাষাদূষণ ও সর্বস্তরে প্রচলনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, ভাষার বিকৃতি ও দূষণ চলছে বহুদিন ধরে। এটি চলতে থাকবে যতদিন ভাষা বিপ্লব না হয়। এর মূল কারণ ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ শাসন করছি, নিজ ভাষা অবহেলিত হচ্ছে। বিষয়কে একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা না করা পর্যন্ত দূষণ বিকৃতি চলতেই থাকবে। আর সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব। ইউরোপের দেশ-চীন-জাপানের দিকে খেয়াল করুন, তারা পেরেছে। চীন-জাপানের ভাষা প্রাগৈতিহাসিক চিত্রলিপির বর্ণমালা। ওই বর্ণমালা দিয়ে যদি আণবিকশক্তি গবেষণা, মহাকাশ গবেষণা সম্ভব হয়, আমরা কেন পারব না? এর জন্য সদিচ্ছা দরকার। শাসনযন্ত্র, শিক্ষিত-সুধীসমাজ যতক্ষণ মাতৃভাষা গ্রহণ না করবে, মাতৃভাষাকে প্রাধান্য না দেবে, ততক্ষণ সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন সম্ভব হবে না। ভাষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আদালত শুধু নির্দেশনাই দিতে পারেন। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের সঙ্গে অনেক প্রতিষ্ঠান জড়িত। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ওইসব প্রতিষ্ঠান সচেতন না হলে আদালতের আদেশ তো উপেক্ষিত থাকবেই।

তিনি বলেন, এবিসি রেডিও প্রথম দিকে বেশ চমৎকার বাংলা দিয়ে শুরু করল। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে সরে অন্য রেডিওগুলোর মতো প্রবণতা গ্রহণ করছে। এফএম রেডিওর নিয়ন্ত্রকরা মনে করে, এ রকম বিকৃত করেই তরুণদের আকৃষ্ট করা যায়। মিডিয়ার ভাষা নামে যে জগাখিচুড়ি ভাষা চালু করেছে, তাতে ভাষার বিকৃতি হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা ইংরেজি থেকে বিশেষ্যগুলো গ্রহণ করব। যেমনÑ থার্মমিটার, প্রেশারকুকার ইত্যাদি। এগুলোর বিকল্প নেই। তবে বিশেষণ ও ক্রিয়াপদগুলো কেন ইংরেজির হাতে তুলে দেব। অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, নিয়মনীতির চেয়ে বড় প্রয়োজন ভাষানীতি। এ সছাড়া দরকার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এ কর্তৃপক্ষ হতে হবে সিটি করপোরেশন, মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্য্যালয়ের শিক্ষক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রসহ যারা ভাষা নিয়ে কাজ করছেন, সবার সহযোগিতা নিয়ে এ কর্তৃপক্ষ কাজ করবে। তারা বাংলা ভাষার ব্যবহারের ব্যাপারে মানুষের বিবেকের তদারকি করবে। তা হলেই ভাষার দূষণ রোধ ও সর্বস্তরে প্রচলন সম্ভব হবে।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা