• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

ব্রেকিং নিউজ

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০১৯  

সরকারি অফিসের সাধারণ কেরানি গোছের চিকনচাকন, লম্বা এবং মোটামুটি বয়স্ক মানুষ তিনি। মাথার চুল সবসময় ছোট রাখেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় এদিক সেদিক দৃষ্টি দেন খুব কম। এমন একটা ভাব, যেন খুব দরকারি একটা কাজ আছে, যেটা রাস্তার পাশের কোনো একটা দোকান থেকে পান কিনে মুখে পুরতে গেলেও ভেস্তে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে তার। বলছিলাম সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণির এক রহমান সাহেবের কথা।

তিনি সকালে লাইব্রেরি স্ট্রিটের ১০ নম্বর বাসা থেকে ঠিক ৭টা ৪৫ মিনিট ১২-১৮ সেকেন্ডের মধ্যেই কেচি গেট খুলে বেরিয়ে পড়েন। দৈনিক একই চরিত্র এবং একই চিত্র। একই সময়, একই পোশাক। কেচিগেট খুলতে গেলে সেটির এক যুগের মরিচা ধরা লোহার পাতগুলোর আড়মোড়া ভাঙার আওয়াজেরও অদ্ভুতভাবে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না৷ অথচ দুনিয়ার সব কিছুই নাকি পরিবর্তনশীল!

এর চেয়ে আলাদা কোনো বিশেষত্ব যদিও রহমান সাহেবের নেই, তথাপি রাস্তায় যেতে আসতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ তাকে সালাম-নমস্কার করে। তাদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি৷ মুখে শুধু হু আর মাথা নেড়েচেড়ে উত্তর দিলেও মনে মনে বেশ অনুভব করেন তিনি। ভাবেন-যাক! সমাজটা তাহলে খুব বেশি রসাতলে যায়নি এখনো। আজকের যুবসমাজের মধ্যে থেকে যে আদব কায়দা কানুন একেবারেই উঠে যায়নি, সেটার প্রমাণ তো এরাই৷ কতো জনকে তো তিনি চেনেনই না, শুধু চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর করে যান৷

তবে প্রিয় পাঠক, আজকের রাস্তার চিত্রের সাথে কোনো এক কেরানি রহমান সাহেবের এত সালাম পাবার ব্যাপারে আপনি নিশ্চয়ই একটু সন্দিহান, তাইতো! তবে আসুন, যেটা রহমান সাহেবও জানেন না, সেই সালাম-নমস্কারের নেপথ্যে আমরা একটিবার বরং ঘুরেই আসি।

লাইব্রেরি স্ট্রিটের ১০ নম্বর বাসা থেকে প্রতিদিন (শুক্র-শনিবারের হিসেব ভিন্ন) ঘড়ির কাটার ঠিক ৯টা ১৭ মিনিট ২৪-৪৮ সেকেণ্ডের মধ্যে কেচিগেট খুলে একটি মেয়ে বের হয়৷ নাম ‘অনু’। পুরো নাম ‘অনুপমা রহমান’। পড়েন শহরের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে। সাপ্তাহিক ছুটি বাদে প্রতিটি ক্লাসেই সে উপস্থিত থাকে। পড়ালেখায় ভালো এবং দেখতে শুনতে অনন্যসাধারণ। রুটিন অনুযায়ী প্রাত্যহিক ক্লাসের সময় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত।  কিন্তু ক্লাসের বাইরেও বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডায় সময় কাটিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরতে বাজে ঠিক ৩টা থেকে ৩টা ১৫মিনিট। এর বেশি সচরাচর ঘটে না। ক্লাসে হেঁটে আসা-যাওয়ার মাঝে প্রথম প্রথম অনেকেই ফুল ছুড়ে প্রেম নিবেদন করতো, কিন্তু ইদানিং এমনটা হয় না৷ বরং কোনো কোনো দিন হঠাৎ পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুয়েকটা ছেলে ছোকড়া বলে-

-আসসালামুআলাইকুম আপা। ভালো আছেন?

-ওয়ালাইকুম আসসালাম।

অবাক হয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করতে গেলে সেই ছেলেগুলো ভিড়ে হারিয়ে যায়৷ ব্যাপারটা রহস্যজনক লাগে অনুর কাছে। কিন্তু নারী এমন এক সৃষ্টি, যে কিনা মাত্র চোখের দিকে তাকালেই বুঝে উঠতে পারে, কে তাকে দেখেছে একটু আলাদা দৃষ্টিতে। কার দৃষ্টিতে তাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা। আর সে আবেদন কার কতো বেশি৷ সুতরাং দর্শনের ছাত্রী অনুপমা রহমানের সেই দৃষ্টিসীমা লঙ্ঘনকারী পুরুষকে চিহ্নিত করতে বেশি সময় লাগলো না।

কিন্তু সেই ভালোবাসার মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থী যত বেশি আবিষ্কৃত হতে থাকলো, অনুপমা রহমানের ভয় এবং শঙ্কা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকলো৷ কারণ, ছেলেটি এলাকার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং লাইব্রেরি স্ট্রিট ও তার আশে পাশের চিপা গলিগুলোতে যত ধরনের আড্ডা বসে, যত হ্যাংলা পাতলা ছেলেরা বিড়ি টানে, পোস্টার লাগায় বা নেতার নামে বিনা দ্বিধায় স্লোগান দেয় এবং এক অর্থে নাশকতা করে তাদের সামনে থেকে নেতৃত্ব প্রদান করে। মাণিক নামে সকলের কাছে পরিচিত। 'ওস্তাদ মাণিক' বলে সবাই৷ ওস্তাদের নাকি জীবনের কোনো ভয় নাই৷ এই বলে বলে সাঙ্গপাঙ্গরা যথেষ্ট শক্তি আর উদ্যমে কাজ করতে থাকে।

কোনো একদিন ক্লাসে যাবার পথে ওস্তাদ মাণিকের চোখে পড়ে অনু৷ সেই দেখাই ওস্তাদ মাণিকের জীবনে আনে ভিন্ন মোড়। সেই প্রথম মাণিক নামের ওস্তাদ ছেলেটি হঠাৎ অনভিপ্রেত অনুভূতির সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত কাবু হতে হতে কোনো একটা সুখানুভূতির রসে চুপসে যেতে থাকে। কিন্তু সেই রসের নদীতে কোনোভাবেই চড় পড়েনা বিধায় ওস্তাদ মার্কা কাজ কর্মে কিছুটা অমনোযোগী ভাব আসে। ওস্তাদির গতি হ্রাস পায়৷ মোটরসাইকেলের চাকা লাইব্রেরি স্ট্রিটের ফুটঅভার ব্রিজের নিচে কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ পায়৷ অনুপমাকে হাঁটা পথে দেখবার আশায় সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হয় এবং একটি দিনও তার অন্যথা হয় না।

আলুথালু ভয় ডরহীন ওস্তাদের ওস্তাদি কর্মকাণ্ডের এমন অস্বাভাবিক পরিবর্তন চামচাদের কপালে ভাঁজ ফেলার উদ্রেক ঘটালে একজন সাহস করে বলেই ফেলে-

-ওস্তাদ, আপনি অনুমতি দেন৷ আমরা ভাবির কাছে গিয়া আপনার মনের কথা কইয়া দেইগা।

-কেন। তোরা কইবি ক্যান? আমার কি মুখ নাই?

-আছে৷ তয় ওস্তাদ, এত দেরি করনডা কি ঠিক? ভার্সিটি পড়ুয়া মাইয়া৷ কহন কে লইয়া যায়৷

এবার খেঁকিয়ে উঠে ওস্তাদ মাণিক।

-কী কইলি? এইডা কি মগের মুল্লুক নাকি, যে চাইলেই লইয়া যাইবো। শোন, তোগর ভাবী হইলো শিক্ষিত মাইয়া। আর শিক্ষিত মাইয়ারা আসল প্রেমিক ঠিকই চেনবো। তোরা বরং একটা কাম করবি। অহন থেইক্যা এলাকায় পোলাপাইন যা আছে সবাইরে ভাবি চিনাই দিবি। আর তোগর ভাবি আর তার বাপেরে যেইহানে দেখবি সবাই সালাম দিবি। কি, কথা মাথায় ঢুকছে?

-জী ওস্তাদ, ঢুকছে। আধাঘণ্টার মধ্যে জানাই দিতেছি।

সুতরাং রহমান সাহেব কেরানি হলেও তিনি এবং তার পরিবার যে এলাকার অঘোষিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবিশেষে পরিণত হয়েছে, সেটা সম্পর্কে শুধু অনুপমা রহমান অনু ছাড়া আর কেউ অবগত ছিল না।

দুই

শহরে তখনো শীতের আমেজ পুরোদমে পরেনি। তবুও সকাল সকাল একেবারে প্রোটেকশন না নিয়ে বাইরে বের হওয়া যায় না।

ঋতুর পরিবর্তন হয় কিন্তু ওস্তাদ মাণিক রোজকার মতো একই জায়গায় দাঁড়ায় প্রিয় মানুষকে দেখবার আশায়। যেন এটা দিনের সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ কাজ। খুব বেশিদিন অবশ্য চুপ করে থাকেনি মাণিক। একদিন চলতি পথে বুক ভরা সাহস নিয়ে অনুর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মনের কথা বলতে গিয়েছিল। কিন্তু প্রেমিকা নামক পৃথিবীতুল্য কারো কাছে মাতৃভাষায় কথা বলাও যে এত কঠিন কাজ, ওস্তাদ মাণিক কল্পনাও করতে পারেনি। কথার মাঝখানে অ্যা, য়ু, মানে, ইয়ে, আহ, গলা ঠিক করা ইত্যাদি অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দের আচমকা উপস্থিতি প্রেম নিবেদনের সুন্দর সুযোগটির মাঝে বিশাল একটা ঘাপলা সৃষ্টি করে এবং অচিরেই ওস্তাদ মাণিক বুঝে উঠে যে, এ কাজে পারদর্শিতা প্রদর্শনের জন্য একই কাজে সফল কোনো ব্যক্তি খুঁজে বের করে  তাঁর কাছ থেকে যথাযথ অনুশীলন করে নিজেকে প্রস্তুত করে তবেই তাকে পুনরায় আসতে হবে। কিন্তু সে চিন্তা শেষ না হতেই অনুপমা বলে উঠে-

- কে আপনি?

-আমি! মানে, ইয়ে.... হ্যা, ইয়ে, আমি মাণিক। মানে, ওই...ওস্তাদ...

- কী, ওস্তাদ মানে?  কার ওস্তাদ?

-আহ, হা হা হা... ওস্তাদ মানে....

-কাজ কাম নাই আপনার? সকাল সকাল সামনে এসে মানে করতেছেন ক্যানো? যান, সরেন। যাইতে দেন। ক্লাস আছে আমার।

একেবারে চুপসে যায় মাণিক। চামচাদের একটা ছুটে এসে বলে-

-আহ, ওস্তাদ, আপনেরে কইলাম আপনি আপনার নাম টা সুন্দর কইরা কইবেন। মুখে হাসি রাখবেন। ধুর! আপনে...

ওস্তাদ মাণিক কোনো প্রকার কথা না বলে বাইকের ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেলে চামচাদের মধ্যে হাসাহাসির রোল পড়ে গেল। হালা নিজের নাম কইতে পারে না, আবার বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী পটাইবো! তবে, ওস্তাদ মাণিকের মধ্যে হাল ছেড়ে দেবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। প্রতিদিন একই সময়ে একই জায়গায় মাণিক বাইক সাইড করে বসে থাকে। সাঙ্গপাঙ্গরা কখনো কখনো বাদাম খায়। কোনোদিন ঝালমুড়ি বা কোনোদিন সংখ্যায় বেশি হলে তাস খেলা জমে উঠে। ওস্তাদ মাণিকের মধ্যে এইসব কিছুতে কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। দৃষ্টি শুধু রাস্তার দিকে। কখন অনু আসবে। মনে মনে নিজের সাথে নিজেই বাজি ধরে....আজ ঠিক নীল পোশাক পরবে। কোনো কোনো দিন দেখা যায় সত্যিই নীল পরেছে অনুপমা রহমান। দেখতে দেখতে সামনে দিয়ে চলে চায়। কখনো আড়চোখে যদি তাকায়ও, মাণিকের দৃষ্টি তা এড়ায় না এবং সে দিনটা মাণিক উৎসবের আমেজে কাটায়৷

এত কিছু ঘটে যায় যাকে নিয়ে। যার জন্য কোনো এক অগোছালো যুবকের এত পালটে যাওয়া, এত অপেক্ষা, একের পর এক স্বপ্ন দেখা কোনোকিছুই অনুপমা রহমানের দৃষ্টি অতিক্রম করে না বরং নারী ইন্দ্রিয় দূরত্ব সীমা অতিক্রান্ত করেই হৃদয়ে অনুভূতির সঞ্চার করে। তবে নারী লেশহীনভাবে সে অনুভূতি অত্যন্ত কৌশলের সাথে সামাল দিয়ে চলতে পারদর্শী। সুতরাং মাণিক নামের কেউ একজন যে প্রতিটি দিন সকাল থেকে তাকে দেখবার আশায় বসে থাকে, রাস্তায় হাঁটবার সময় তার পিছু পিছু আসে, তাকে আর দশটা বখাটে হতে পেছন থেকে রক্ষা করে, তাকে নিয়ে কল্পনার রজ্যে ঘুরে বেড়ায়, তাকে নিয়ে জীবন কাটানোর স্বপ্নে বিভোর এ সবই অনুপমা রহমানের অবগত৷ কিন্তু তারপরও, যার তার সাথে নিজেকে জড়ানোর মতো রুচিবোধ তার নেই। মানুষের রুচিই সভ্যতার বিচারক।

মাস দুয়েকের মধ্যে মাণিক কয়েকবার প্রেম নিবেদনের চেষ্টা চালিয়েছে কিন্তু যেই মাত্র বুঝেছে যে তার প্রেজেন্টেশন কারো হৃদয়ে বিন্দুমাত্র অনুভূতির আলোড়ন ঘটায়নি, সঙ্গে সঙ্গে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। একদিন দুপুরে ওস্তাদ মাণিক তার ওস্তাদ কর্ম সম্পাদনের সময় হঠাৎ অনুকে বাবুবাজার ব্রিজের নিচের রাস্তায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে অবস্থায় আবিষ্কার করে। বাইক নিয়ে অনুর সামনে যেতেই অনু কান্না জুড়ে দেয়। মাণিকসহ চামচাদের সবাই রীতিমত অবাক৷ কিছুক্ষণ পর অনু কান্না থামিয়ে বলে-

-গুলিস্তান থেকে দৌড়ে পালিয়েছি। কারা যেন ছুরি দিয়ে আমাদের মারতে যাচ্ছিল। আমার বন্ধু সুমনকে কিছু করেছে কিনা বলতে পারছি না। মনে হয় হাইজ্যাকার৷ সুমন কই আছে৷ আমি তো পালিয়েছি!

ভয়ে কাঁপতে থাকে অনুপমা রহমান অনু। ওর এই চেহারা দেখে মাণিকের বুকটা একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে উঠে। একবার পেছন ফিরে সাঙ্গপাঙ্গদের দিকে তাকাতেই একজন বলে উঠে "কইতে হইবোনা ওস্তাদ, দেখতাছি। আপনি ভাবিরে পৌঁছাইয়া দেন।"

মাণিক অনুকে বাইকে তুলে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চাইলেও অনু ভার্সিটির গেইটে নেমে বাকিটা হেঁটে যায়। পেছনে পেছনে মাণিকও আসে। বাসায় ঢুকবার আগে অনু একবার পেছন ফিরে তাকায়। একটু মৃদু হাসি দেখা যায় ওর মুখে। ভয় আর লজ্জ্বা মেশানো এক টুকরো হৃদয় হননকরা হাসি।

তিন

পর দিনের দৃশ্যপট একটু ভিন্ন হয়। অনুপমা রহমান অনু কেচিগেট খুলে রাস্তায় এসে ফুটওভার ব্রিজের নিচে কাউকে খুঁজে পায় না। অন্যদিনের মতো আড়চোখে না তাকিয়ে এবার ভালো করে লক্ষ করে অনু। সত্যিই কাউকে দেখা যায় না। প্রাত্যহিক চিত্রের অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিবর্তনও হঠাৎ হঠাৎ অস্বস্তির উদ্বেগ করে৷ অনু আস্তে আস্তে হেঁটে ব্রিজটা পার হয়। ঘড়িতে সময় সেই একই। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন ‘অনুপমা’ বলে ডাক দেয়। পেছন ঘুরতেই ওস্তাদ মাণিককে দেখা যায়। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে সে বলে-

- কাল ভয় পাইছিলা খুব।

- হুম। অনেক। আর হ্যা। আপনাকে ধন্যবাদ। আমাকে সাহায্য করার জন্য।

- এ আর তেমন কি সাহায্য। একটা ব্যাপারে তোমারে দরকার ছিল, দুই মিনিটের কাজ। তোমার কি ক্লাসে খুব দেরি হয়ে যাবে?

- না, হবে না। বলেন।

- আচ্ছা, তোমারে যে ছুরি মারতে যাচ্ছিল, তার চেহারাটা মনে আছে তোমার? দেখলে কি চিনতে পারবে?

- হ্যা, আমি একদম স্পষ্ট দেখেছি লোকটাকে। আমার মুখের কাছে চলে আসছিল রাস্কেলটা।

-আচ্ছা, তাহলে তো ভালই হল। 

মাণিক জোরে মমিন বলে ডাক দিল। পেছন থেকে মমিন নামের হ্যাংলা পাতলা কালো সাঙ্গ সাথে আর দুইজন হাত পা বাঁধা একজনকে টানতে টানতে অনুপমার সামনে নিয়ে আসে। মাণিক বলে-

-দ্যাখো তো। এই ছিল কিনা?

অনুপমার চিনতে ভুল হয় না। তবে তার ইতিবাচক উত্তরে হাইজ্যাকার ছেলেটির কি পরিণতি হয় মনে মনে তা কল্পনা করে ভয়ে আঁতকে উঠে সে। হাত পা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছেলেটির জন্য করুণা জন্মে। আস্তে করে মাথা নাড়িয়ে অনু বলে-

-নাহ। মনে হচ্ছে এ নয়। একে এভাবে বেঁধে রেখেছেন কেন? খুলেন একে।

মমিনকে চোখের ইশারা দিতেই মমিন বাঁধন খুলতে শুরু করে। হাইজ্যাকার ছেলেটি নিজেও অবাক হয়ে যায়। মাণিক বলে-

-আজকে যদি তুই এই কাজ করতি রে...যাহ, ভাগ৷

দৌঁড়ে পালায় ছেলেটি৷ মাণিক কিছু একটা বলতে যেতেই অনু বলে উঠে, এবার আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসি। বলেই হাঁটতে থাকে সে।

মাণিক আর কথা বাড়ায় না। চলে আসে নিঃশব্দে।

চার

আরও কয়েক মাস এভাবেই গেল। নতুন বছর। শীত। অনুপমা রহমান অনু দ্বিতীয় বর্ষের পালা শেষ করে তৃতীয় বর্ষের অধ্যয়ন শুরু করে। রহমান সাহেবের চাকরিতে পদোন্নতি ঘটে না৷ সকাল সকাল কেচিগেইটের শব্দেরও কোনো ব্যতিক্রম কারো চোখে পড়ে না। সেই সাথে মাণিক নামের ওস্তাদ ছেলেটিরও কোনোরূপ পরিবর্তন আসে না।

তবে অনুপমা রাস্তায় হেঁটে যেতে আগের চেয়ে বেশি নিরাপদ বোধ করে। সবসময় নিজেকে কোনো একটা অদৃশ্য নিরাপত্তায় আচ্ছাদিত বোধ করে৷ কখনো মাণিক এগিয়ে এসে কথা বলতে চাইলে এখন আর আগের মতো সেই বিরক্তি এসে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং কোনো এক বখাটে অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে যদি কোনো একদিনও অনুপস্থিত থাকে, তবে সারা দিনে অগণিত বার একটা চিন্তা বারবার মনের অবরুদ্ধ দরজায় মৃদু কড়া নাড়তে থাকে এবং নাড়তেই থাকে।

আরও কিছুদিন এরকম চলতে থাকলে হয়তো বখাটে আর অনুর গল্পটার একটা চমৎকার পরিণতি ঘটতেই পারতো। কিন্তু তার আগেই কোনো এক ছুটির দিনের সকালে রহমান সাহেব চা খেতে খেতে জোড়ে বললেন...

-দ্যাখছ দ্যাখছ, নিউজ দ্যাখছ! দেশের বিশাল বড় একটা আপদ বিদায় হইছে। আল্লায় বাঁচাইছে।

অনুপমা রহমান কৌতূহল নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে টিভির পর্দায় তাকায়। প্রতিটি চ্যানেলে একই ব্রেকিং নিউজ-গত রাতে শ্যাম বাজারের সবজীর আড়তে মাদক চোরাচালানের সময় র‍্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে ১৩ মামলার জামিনপ্রাপ্ত আসামি 'মাণিক' ওরফে 'ওস্তাদ মাণিক' নিহত৷

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা