• বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

শরীরে ট্যাটু আঁকার আজব সব রীতি

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ২৪ এপ্রিল ২০২০  

শিশুটি চিৎকার করে কাঁদছে। বয়স তার ছয় কি সাত মাস! জোর করে শিশুটির হাতে আঁকা হচ্ছে ট্যাটু। সেই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শিশুটি। অভিভাবকই ট্যাটু করতে নিয়ে এসেছে শিশুটিকে। তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী ছোটবেলায় হাতে সামান্য ক্রস চিহ্ন আঁকা বাধ্যতামূলক। আর এ কারণেই শিশুটির বাবা-মা তাকে নিয়ে এসেছে হাতে ট্যাটু করাতে। 

মিশরের বাসবাসকারী কপটিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা এমনই আজব রীতি অনুসরণ করে। তারা খুবই গৌরবের সহিত নিজেদের ঘাড়ে, গলায় অথবা হাতের যে কোনো জায়গায় ক্রস চিহ্ন আঁকিয়ে ধর্মীয় রীতি পালন করে। শিশুর শরীরের প্রথম ট্যাটুকে তারা ‘বেবিস ফার্স্ট ক্রস’ বলে অভিহিত করে।

কোনো প্রকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা না মেনেই শিশুর শরীরে সুঁচ দিয়ে ক্রমাগত গর্ত করে তাতে সিগারেটের ছাঁই ব্যবহার করে ট্যাটু করা হয়। শুধু এখানেই নয় বরং প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ট্যাটুর প্রচলন রয়েছে। কোথাও ফ্যাশনের তাগিদে আবার কোথায় ধর্মীয় রীতিনীতি চর্চায় ট্যাটু প্রচলিত।

 

সবার হাতেই ট্যাটু

সবার হাতেই ট্যাটু

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের রুচিবোধও বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে স্টাইলের। যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ফ্যাশন ভাবনা। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হওয়া তেমনই একটি স্টাইল শরীরে ট্যাটু আঁকা। শরীরে স্থায়ী ছাপের মাধ্যমে বিভিন্ন নকশা করাই ট্যাটু হিসেবে পরিচিত। ট্যাটুর একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এটা আদিম সংস্কৃতির অংশ। ট্যাটুর ইতিহাস নিয়েই আজকের লেখা।  

ট্যাটু আঁকার প্রচলন কয়েক হাজার বছরের পুরাতন। প্রাচীন মমি করা শরীরে ট্যাটুর চিহ্ন পাওয়ার পর শক্ত প্রমাণ সৃষ্টি হয় যে, এটা প্রাচীন শিল্পের একটি কাঠামো। মানব শরীরে পাওয়া প্রাচীন ট্যাটুর প্রমাণ খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৭০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ অব্দের মধ্যে বলে মনে করা হয়। ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বরে ওটজি দ্য আইসম্যান আবিষ্কৃত হয়। 

এটি মূলত একটি মমিকৃত শরীর। যার সময়কাল ছিল আনুমানিক ৩৩২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। ওটজাল আল্পস থেকে পাওয়ার কারণে এটার নাম ওটজি দ্য আইসম্যান। প্রাকৃতিকভাবেই এটি মমিকৃত এবং সংরক্ষিত ছিল। যা ইউরোপের প্রাচীনতম মানব শরীরের মমি। 

 

ওটজি দ্য আইসম্যান

ওটজি দ্য আইসম্যান

ওটজি আইসম্যানের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েক রকমের মোট ৬১টি ট্যাটু আছে। যেগুলোর বেশিভাগই তার পায়ে আঁকা। মমিটি নিবিড়ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে স্পষ্ট হয়েছে তার শরীরের ট্যাটু আঁকতে স্যুট বা ফায়ারপ্লেস অ্যাশ ব্যবহার করা হয়েছিল। ওটজি মানব শরীরে প্রমাণ পাওয়া প্রথম ট্যাটু হলেও অন্যান্য যুগেও এর প্রচলন ছিল। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪৯টিরও বেশি স্থান থেকে ট্যাটু আঁকা মানব শরীরের মমির সন্ধান মিলেছে।

আলাস্কা, মঙ্গোলিয়া, গ্রিনল্যান্ড, মিশর, চীন, সুদান, রাশিয়া এবং ফিলিপাইন থেকে ট্যাটুযুক্ত মমিগুলো পাওয়া গেছে। এই সমস্ত আবিষ্কারগুলো প্রাচীন ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন সময়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এর মধ্যে কয়েকটির সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ২১০০ অব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাচীন সভ্যতাগুলোতে ট্যাটু আঁকার পেছনে তত্ত্ব, রীতি-নীতি, ঐতিহ্য সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু বিষয় জড়িত ছিল। তেমনই কয়েকটি সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। 

 

এক নারীর শরীরে ট্যাটু করা হচ্ছে

এক নারীর শরীরে ট্যাটু করা হচ্ছে

চীন এবং এশিয়া

চীনের পশ্চিম অঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশের কয়েকটি কবরস্থানে ট্যাটু আঁকা মমি আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে বেশকিছু মমি ২১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের এবং কিছু কিছু আনুমানিক ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্ব্দের। অবশ্য প্রাচীন চীনা রীতিগুলোর মধ্যে ট্যাটু করা বর্বর রীতি হিসেবে বিবেচিত হত এবং এটি কলঙ্কজনক বিষয় ছিল। চীনে মূলত ডাকাত, চোর এবং দাসদের চেনার জন্য ট্যাটু করা হত। কেউ গুরুতর অপরাধ করলে তাদের মুখে ট্যাটু এঁকে দেয়া হত। 

মিশর

প্রাচীন মিশরে ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে ট্যাটু আঁকার রীতি প্রচলিত ছিল। কিছু তত্ত্ব থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় সৌন্দর্য বর্ধনের কারণেই প্রাচীনকালে সেখানে ট্যাটু আঁকা হত। ড্যানিয়াল ফ্যুয়েটের গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রাচীন মিশরে ট্যাটু আঁকা চিকিৎসারও অংশ ছিল। 

 

দল বেধে পুরুষরা শরীরে ট্যাটু করছে

দল বেধে পুরুষরা শরীরে ট্যাটু করছে

তিনি ট্যাটুর বিভিন্ন প্রকার চিহ্ন থেকে অনুমান করেছেন হয়তো এগুলো পেলভিক পেরিটোনাইটিসের চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করা হত। প্রাচীন মিশরে শুধু নারীদের শরীরেই ট্যাটু আঁকা হত বলে গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে। তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ৪০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে নুবিয়ান পুরুষদের মধ্যে এর প্রচলন হয়। 

সামোয়া

ট্যাটু আঁকা রীতি কয়েক হাজার বছর ধরে সামোয়ান সংস্কৃতির অংশ। এটা তাদের সামাজিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। আধুনিক ইংরেজি ট্যাটু শব্দটি সামোয়ান ‘টাটা’ শব্দ থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হয়। সেখানে বংশ পরম্পরা অনুযায়ী এর প্রচলন প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো। 

প্রাচীন রোম এবং গ্রীস

লিখিত ইতিহাস অনুযায়ী আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে গ্রীসে ট্যাটু প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সময় মূলত রোম এবং গ্রীসে অপরাধী এবং দাসদের চিহ্নিত করতে ট্যাটু আঁকা হত। এছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে ট্যাটু আঁকা নিয়ে এক এক ধরনের রীতি, বিশ্বাসের প্রচলন ছিল। 

জাপানিরা প্রাচীনকালে সৌন্দর্য বর্ধনে এবং ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে ট্যাটু করত। ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে ট্যাটু নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও নর্থ আমেরিকার দেশগুলোতে এটাকে ম্যাজিকাল শক্তির প্রতীক হিসেবে দেখত। অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা পেতেও বিভিন্ন জায়গায় ট্যাটু আঁকার নিদর্শন পাওয়া যায়। 

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা