• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

শেখ সাহেব থাকলে একটা কিছু তো করতেন

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

জন্ম ও পেশাগত কারণে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার দলিত সম্প্রদায়ের একটি জনগোষ্ঠী হরিজন সম্প্রদায়। বাংলাদেশে বাঙ্গালি, অবাঙ্গালি মিলিয়ে দলিতদের সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। রাজধানীর পুরান ঢাকার আগাসাদেক রোডে হরিজন সম্প্রদায়ের মিরনজিল্লা সিটি কলোনিতে বাস করছে প্রায় ৪ হাজার পরিবার। এই কলোনির জনগোষ্ঠীর সাথে মুক্তিযুদ্ধের একটি গল্প আছে। 

১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকাররা এই কলোনি থেকে ধরে নিয়ে যায় ১০টি তাজা প্রাণ। পরে তাদেরকে হত্যা করে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ওই দশজনের একজন ছিলেন আনবার লাল। ওই দিনের ঘটনা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তার স্ত্রী বনো দেবিকে।

বনো দেবি বলেন, রাত তখন তিনটা। হঠাৎ ওরা ওকে ধরে নিয়ে যায়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় নিয়ে যাও? বললো, বেশি কথা বললে মেরে ফেলবো। এতো কিছুর পরেও আমরা অবহেলিত। শেখ সাহেব থাকলে আমাদের সমস্যা হতো না। একটা কিছু তো তিনি করতেন।

শহীদ ওই দশ জনের একজন রাম চন্দ্র দাস। ঘটনার সময় তার স্ত্রী রানী ছিলেন সন্তান সম্ভাবা। বয়সের ভারেও ভুলে যাননি কিছুই। তিনি বলেন, এই ঘটনার সময় আমার পেটে আট মাসের মেয়ে ছিল। উনারা দুইজন বসে ছিল। সন্ধ্যার পর পাকিস্তানি মিলিটারিরা তাদেরকে ধরে নিয়ে গেল। আর পেলাম না।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এসব পরিবারে এখন বড়ে উঠছে নতুন প্রজন্ম। পড়ালেখায় ভালো করলেও ভোগান্তির শেষ নেই চাকরির ক্ষেত্রে। রাম চন্দ্র দাসের মেয়ে বলেন, তার তিনটি মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়ে স্নাতক ৩য় বর্ষে পড়ালেখা করছে। মেঝো মেয়ে পড়ছে এইচএসসি ২য় বর্ষে। আর ছোট মেয়ে নবম শ্রেণীতে। আক্ষেপ করে বলেন, পড়া লেখা করিয়ে লাভ কি? চাকরি হবে না তো। চাকরি পেতে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা দরকার। এতো টাকা কিভাবে দিবো? 

মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অনেকের নাম সরকারি নথিতে লিপিবদ্ধ থাকলেও এই ১০ জনের নাম নেই। কোনো স্বীকৃতিও পাননি তারা। তবুও তাদেরকে ভুলে যায়নি হরিজন সম্প্রদায়। তাদের স্মরণে এই কলোনিতে ১৯৭২ সালে নিজ উদ্যোগে ইট-বালু দিয়ে তৈরি করেছিলেন ছোট একটি শহীদ মিনার। এখানেই প্রতিবছর শহীদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে আসছেন তারা। এই শহীদ মিনারে বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) শ্রদ্ধা জানাতে আসেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। শহীদদের স্বীকৃতির বিষয়ে কথা বলেন তিনি। 

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, আমরা হরিজন সম্প্রদায়ের এই শহীদদের কথা শুনে এখানে এসে তাদের প্রতি সম্মান জানিয়েছি। জাতি বর্ণ নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে যারাই অংশ নিয়েছে তাদেরকে সম্মান দেয়া উচিত। আমাদের নিকট এই হরিজন সম্প্রদায় যে স্মারকলিপি দিয়েছে আমরা সেটি যথা স্থানে পৌঁছে দেবো। এছাড়া তাদের স্বীকৃতির বিষয়ে আমাদের সদস্যদের মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে আমাদের স্লোগান ‌'বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে আমাদের অঙ্গিকার, লঙ্ঘন হবে মানবাধিকার'। এটিকে বাস্তবায়ন করা আমাদের লক্ষ্য। 

এমন আশ্বাসের বাণী ও সুযোগ-সুবিধার কথা তারা শুনেছেন বহুবার। তবে বাস্তবতা বিপরীত। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের সম্মান ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয় এসব অবহেলিত সম্প্রদায়ের। বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদের মহাসচিব নির্মল চন্দ্র দাস বলেন, হরিজন সম্প্রদায়ের এই কলোনিতে বঙ্গবন্ধুসহ বর্তমানের অনেক নেতারা এসেছেন কিন্তু, কেন এই ১০ জন শহীদকে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না জানা নাই তাদের। বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের সভাপতি মনি রানী বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া এসব পরিবার খুব কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করে। ছেলে মেয়েকে পড়া-লেখা করাতে কষ্ট হয়ে যায়। আর কোনোভাবে শিক্ষিত করলেও চাকরি হয় না। এছাড়া আমাদের থাকার জায়গাও বেশি বড় না। অল্প জায়গায় আমাদের এক সাথে কষ্ট করে থাকতে হয়। বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক ভীম্পাল্লী ডেভিড রাজু বলেন, হরিজন বা সুইপাররা শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি পাক, তা হয়তো কেউ চায় না। তাই আমরা এ পর্যন্ত স্বীকৃতি বা সম্মানটুকু পাইলাম না। মুক্তিযুদ্ধে নিহত এসব পরিবারকে শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আর কত কাল অপেক্ষা করতে হবে?

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা