• শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ৫ ১৪৩১

  • || ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি: তৃতীয় স্থানে কাজী নজরুল ইসলাম

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ১৫ মার্চ ২০২০  

‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে?’ বিষয়ের ওপর ২০০৪ সালে একটি শ্রোতা জরিপের আয়োজন করে বিবিসি বাংলা। সেই জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় তৃতীয়তম স্থানে আসেন অসাম্প্রদায়িক মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

আজ রোববার তার জীবন-কথা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।

প্রতিবেদনটি পাঠকদের জন্য তুলে দেয়া হলো-

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যার গান ও কবিতা যুগে যুগে বাঙালির জীবন সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র পরিবারে দুখু মিয়া হয়ে জন্মেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

১৮৯৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয়।

তার বাবা ছিলেন কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহিদা খাতুন। বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মভিত্তিক। তার ভবঘুরে বাল্যকাল আর তার স্কুল শিক্ষা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে।

অল্প বয়সে স্থানীয় মসজিদে তিনি মুয়াজ্জিনের কাজ করেছিলেন। কৈশোরে ভ্রাম্যমাণ নাটক দলের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে সাহিত্য, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে বাল্যকালে খানসামা ও চায়ের দোকানে রুটি বানানোর কাজ করেছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন নজরুল।

এ বিষয়ে নজরুল গবেষক জিয়াদ আলি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তরুণ বয়সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন নজরুল। করাচিতে গিয়েছিলেন ১৯১৭ সালে। স্বাধীনতা সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা থেকেই তিনি যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। ১৯২০ সালে তিনি যখন কলকাতা ফিরে গেলেন, তখন কিন্তু তার মূল স্বপ্নই ছিল ভারতকে স্বাধীন করা। তিনি বহু লেখায় বলেছেন সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে হবে।’

নজরুলের কবিতায় ফুটে উঠে সেই দ্রোহ আর স্বাধীনতার ডাক।

দাসত্বের শৃঙ্খলে বদ্ধ জাতিকে শোষণ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্ত হবার ডাক দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘বল বীর বল উন্নত মম শির,...যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না -বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত!’

সেনাবাহিনীর কাজ শেষ করে কলকাতায় ফেরার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙার গানের’ মতো কবিতা এবং ধূমকেতুর মতো সাময়িকী।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তার ভূমিকার জন্য বহুবার কারাবন্দি হয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। জেলে বন্দি অবস্থায় লিখেছিলেন¬–‘রাজবন্দির জবানবন্দি’। তার এসব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল প্রকট।

সাংবাদিকতার মাধ্যমে এবং পাশাপাশি তার সাহিত্যকর্মে নজরুল শোষণের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

কবি নজরুল ইসলাম মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তার একটি কবিতার বিখ্যাত একটি লাইন ছিল– মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।

কবির এক ভাইয়ের ছেলে কাজী মাজহার হোসেন বলেন, ‘নজরুল ছিলেন সব ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে। তার একটি কথাতেই এটি পরিষ্কার হয়েছে, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়’'।

কবির যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি বলেও মনে করেন কাজী মাজহার।

তবে নজরুল ইসলামের নাতি সাগর কাজী বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন– তার বন্ধুবান্ধবরা নজরুল ইসলামকে মনের মন্দিরে বসিয়ে রেখেছেন। তারা মনে করেন নজরুল তাদের জন্য একজন পথের দিশারি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী নজরুল ইসলামকে বর্ণনা করেছিলেন– ‘ছন্দ সরস্বতীর বরপুত্র’ হিসেবে। অনেক বিশ্লেষক বলেন, তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা তাকে অমর করে রেখেছে।

নজরুলের প্রতিভার যে দিকটি ছিল অনন্য, সেটি হলো তার বিদ্রোহী চেতনার বহির্প্রকাশ– সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি সব কিছুর বিরুদ্ধেই বিদ্রোহে তিনি সোচ্চার হয়েছেন তার সাহিত্যকর্ম ও সংগীতে।

গবেষক জিয়াদ আলি বলেছেন, তিনি কিন্তু শুধু কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন গীতিকার, সুরকার, গল্পকার, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী। নজরুল সম্ভবত ওই সময়ের প্রথম বাঙালি, যিনি বাংলার নবজাগরণের যে ঐতিহ্য সেটি ধারণ করেছিলেন এবং তার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালিকে একটা শক্ত, সবল নতুন চেহারা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

কলকাতায় অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত জীবন তার সাহিত্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। নজরুল উঠে এসেছিলেন সমাজের অতি পিছিয়ে থাকা শ্রেণি থেকে। শুধু দারিদ্র্যই নয়, শিক্ষার অভাবের মধ্য দিয়ে তিনি বড় হয়েছিলেন। প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থেকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার জীবন কেটেছিল।’

নজরুল সম্পর্কে একাধিক গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক মুস্তফা নুরুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন,‘প্রতিকূলতায় ভরা ওই জীবনের মধ্য দিয়েই নজরুলের প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ ছিলেন নজরুল। যে পথ দিয়ে তিনি গেছেন, যে প্রকৃতিতে তিনি লালিত হয়েছেন, যে পারিপার্শ্বিকতায় তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেগুলো তার অজান্তেই তার ওপরে ছাপ ফেলে গেছে। তারই বহির্প্রকাশ ঘটেছিল তার গানে ও কবিতায়।

গবেষক জিয়াদ আলী বলেন, কথিত আছে– কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে হ্যারিসন রোডের মুখে একটি রিকশাওয়ালাকে তিনি একদিন রাত ১২টায় গিয়ে বলেছিলেন– এ্যাই তুই তো অনেককেই নিয়ে যাস রিকশায় টেনে। ঠিক আছে আজ তুই রিকশায় বোস আর আমি তোকে টেনে নিয়ে যাই।

তার সাহিত্যকর্মেও প্রাধান্য পেয়েছে মানুষের প্রতি তার অসীম ভালোবাসা আর মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

নজরুল জীবনীকার অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘নজরুল তার ধূমকেতু পত্রিকায় কংগ্রেস স্বাধীনতা দাবি করার আগেই ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেছিলেন। সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাও তিনি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন।’ নবযুগ নামে একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৯২০ সালে। অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন একে ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল ইসলাম নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন।

গল্প, উপন্যাস, নাটকও রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষায় একটা নতুন প্রাণ নতুন তারুণ্য নিয়ে এসেছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন একটা নিজস্ব ভাষার, যে ভাষার মধ্যে তিনি দেশজ বাংলার সঙ্গে সফলভাবে ঘটিয়েছিলেন বহু আরবি ও ফারসি শব্দের সংমিশ্রণ।

নজরুল প্রায় ৩ হাজার গান রচনা করেছিলেন এবং অধিকাংশ গানে নিজেই সুরারোপ করেছিলেন যেগুলো এখন ‘নজরুল গীতি’ নামে বিশেষ জনপ্রিয়।

গজল, রাগপ্রধান, কাব্যগীতি, উদ্দীপক গান, শ্যামাসংগীত, ইসলামী গান বহু বিচিত্র ধরনের গান তিনি রচনা করেছেন।

বিশ্লেষক রফিকুল ইসলামের মতে, ‘নজরুল যেভাবে উত্তর ভারতীয় রাগসংগীত এবং বাংলার লোকসংগীতকে মেলালেন। এর আগে যথার্থ অর্থে সেভাবে বাংলা গান রাগসংগীতকে অনুসরণ করেনি। তার ছিল এই মিশ্রণের অসামান্য প্রতিভা- সাহিত্যে, সংগীতে, রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে সর্বত্র তিনি এই সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন।’

মধ্যবয়সে এক দুরারোগ্য রোগে কবি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে সপরিবারে অসুস্থ নজরুল ইসলাম ঢাকায় চলে যান। ১৯৭৬ সালে ২৯ অগাস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবির জীবনাবসান হয়।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা