• মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

সাহাবিদের মৃত্যুর ভয়ের দৃষ্টান্ত

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০  

সাহাবিরা হলেন আমাদের ঈমান আমলে মডেল। তারা ঈমান ও আমল সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দেখে দেখে শিখেছেন। তাই ওলামায়েকেরাম বলেন, উম্মতে ঈমান ও আমলের মাপকাঠি সাহাবায়েকেরাম। 

সেই সাহাবিরা নিজের জীবনের ওপর, নিজের আমলের ওপর, নিজের মৃত্যু নিয়ে কত চিন্তিত ছিল। নিজেকে একেবারে তুচ্ছ মনে করতো। যার কারণে আল্লাহ তাদের ওপর খুশি হয়ে কোরআনে ঘোষণা দিচ্ছেন, 

رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ أُولَئِكَ حِزْبُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ 

‘তাদের ব্যাপারে আল্লাহ রাজি ও সন্তুষ্ঠ, তারাও আল্লাহর ব্যাপারে রাজি ও সন্তুষ্ঠ। এরাই আল্লাহর দল। এরাই সফলকাম।’ (সূরা: মুজাদালাহ, আয়াত: ২২)।

হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.):

খুলাফায়ে রাশেদিনের মধ্যে প্রথম হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)। তার সম্পর্কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি যদি আমার উম্মতের কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু রূপে গ্রহণ করতাম তবে আবু বকরকে গ্রহণ করতাম।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ: ৫৫৪)।

হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সাধারণ জান্নাতিরা উপরের শ্রেণির জান্নাতিদের তেমন দেখতে পাবে যেমন- তোমরা আকাশের তারকারাজি দেখতে পাও। আবু বকর ও ওমর উচ্চ শ্রেণির জান্নাতীদের অন্তর্ভূক্ত।’

আলেমরা লেখেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমাকে বানানোর পর কিছু মাটি অতিরিক্ত হয় সেই মাটি দিয়ে আল্লাহ তায়ালা আবু বকরকে সৃষ্টি করেছেন। পরে আরো কিছু মাটি বেশি হয় সেই মাটি দিয়ে ওমরকে সৃষ্টি করেছেন।’

একই মাটি ছিল। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদের একই স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। মাটি একত্র হয়ে গেছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আমি সবার অবদানের বিনিময় পরিশোধ করেছি। আবু বকর! তোমার অবদানের বিনিময় কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা দেবেন।’

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর তাঁর এত অবদান! তিনি নবীজির (সা.) এমন সাহাবি!! আবু বকর যুদ্ধের প্রাক্কালে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেন, আল্লাহর পথে দান কর। হজরত ওমর (রা.) বলেন, তখন আমার সামর্থ ভালো ছিল। আমি মনে মনে ভাবলাম, আজ আমি আবু বকরকে ছাড়িয়ে যাব। সুতরাং আমি  ঘরের অর্ধেক সম্পদ নিয়ে আসলাম। 

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে পেশ করলাম। আল্লাহর রাসূল জিজ্ঞাসা করলেন, ওমর! কী এনেছ? আমি বললাম, অর্ধেক রেখে এসেছি আর অর্ধেক এনে আপনার দরবারে পেশ করেছি। হজরত ওমর (রা.) বলেন, ইতোমধ্যেই সেই ফকির, সেই আশেকে রাসূল (হজরত আবু বকর সিদ্দীক রা.) চলে আসে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আবু বকর! তোমার ঘরের জন্য কি রেখে এসেছ?’ উত্তরে তিনি নিবেদন করলেন, ‘আমি আমার পরিবারের লোকদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ: ৫৫৪)।

আল্লাহু আকবার! সারা ঘরের সব সম্পদ। এমনকি কাপড় খোলে চট পরেছেন। নিজের পরনের পোশাকও এ যুদ্ধের জন্য দান করেছেন। শুধু এতটুকুই নয়। দেয়ালে হাত রেখে খোঁজেছেন, কোথাও কোনো সুঁই তো নেই। থাকলে আমি সেই সুঁইও যুদ্ধের জন্য দেব।

তিনি যখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দবারে এ সব সম্পদ পেশ করেন তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবাক হয়ে যান, সব কিছু দিয়ে দিয়েছে! তখন হজরত জিবরাঈল (আ.) অবতরণ করলেন। সালাম করে বললেন, ‘হে আল্লাহর প্রিয় নবী! আল্লাহ তায়ালা  আবু বকরের জন্য সালাম প্রেরণ করেছেন।’ 
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন, হজরত জিবরাঈল (আ.) চটের পোশাক পরা। শাইখুল হাদিস (রহ.) বলেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাঈল! আজ চটের পোশাক কেন? তিনি জানালেন, ‘হে আল্লাহর প্রিয় নবী! হজরত আবু বকরের এ আমলে আল্লাহ তায়ালা এত বেশি খুশি হয়েছেন যে, আল্লাহ তায়ালা আকাশের ফেরিশতাদের আদেশ করেছেন, আজ তোমরাও আবু বকরের মতো পোশাক পর।’ অতঃপর জিবরাঈল (আ.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যাও। আবু বকরকে জিজ্ঞাসা কর, এ অবস্থতাতেও তুমি কি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট আছ?’

এ কথা শোনে হজরত আবু বকরের চোখে অশ্রু এসে গেল। তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমি আমার আল্লাহর ওপর সব সময়ে সন্তুষ্ট আছি।’ এখন ভেবে দেখুন। যে সাহাবির ব্যাপারে আরশ থেকে সালাম আসে তার ব্যাপারে কিতাবে কি লিখা আছে?

তিনি যখন কোনো পাখি দেখতেন তখন বলতেন, ‘হে পাখি! তোমাকে শুভেচ্ছা। এ গাছের ওপর কত নিশ্চিন্তে বসে আছ। গাছের ফল খাবে আর মারা যাবে। আল্লাহ তায়ালা তোমাকে চির দিনের জন্য শেষ করে দেবেন। ইস! আমি যদি তোমার স্থানে হতাম! আবু বকর (রা.) তোমার মতো হত!’

আবার কোনো সময় বলতেন, ‘আক্ষেপ! আমি যদি তরু-লতা হতাম! যা বিভিন্ন জানোয়ার খেয়ে শেষ করে ফেলত!’
এ কথাগুলো বলার দ্বারা তার উদ্দেশ্য কী ছিল? আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোকে, আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়াকে তিনি অত্যাধিক ভয় করতেন। তিনি বলতেন, আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার সাধ্য আমার নেই।’

হজরত ওমর ফারুক (রা.):

হজরত ওমর ফারুক (রা.) এর ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ! হে ওমর! তুমি যে পথ দিয়ে চল শয়তান সেই পথ ছেড়ে দেয়।’ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন, ‘আগের উম্মতদের অনেকেই এমন হতো যে, তাদের কাছে ইলহাম আসত। আমার উম্মতের মধ্যে যদি এক জন ব্যক্তিও এমন হয় তবে সে হবে ওমর।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ: ৫৫৪)। এ হলেন সেই ওমর। যার মতো অনেক বিষয়ে কোরআনের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে।

সেই ওমর বলতেন,‘যদি সারা দুনিয়া সমান সোনা আমার থাকত আর আমি তা আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর বিনিময়ে দিয়ে দিতে পারতাম তবে তা দিতাম।’ আবার কখনো বলতেন, ‘দুর্ভাগ্য আমার! দুর্ভাগ্য আমার মায়ের! যদি আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন আমার ওপর দয়া না করেন।’ আরেকবার জানোয়ারের খাবারের দিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘আমি যদি এ ভুসির মতো হতাম!’ ‘আক্ষেপ! আমার মা যদি আমাকে জন্ম না দিতেন!’ ‘আক্ষেপ! আমি যদি অস্তিত্ববান না হতাম!’ ‘আক্ষেপ! আমি যদি হারিয়ে যাওয়া বস্তু হতাম।’ 

একবার তিনি নামাজ পড়া আরম্ভ করেন। যখন পবিত্র কোরআনের এ আয়াতে পৌঁছেন,

وَقِفُوهُمْ إِنَّهُمْ مَسْئُولُونَ

‘এবং তাদের থামও। তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে।’

তখন তিনি কান্না আরম্ভ করেন। এমনকি কান্নার আওয়াজ জামাতের শেষ কাতার পর্যন্ত পৌঁছে। অতঃপর এ চিন্তায় এক মাস পর্যন্ত অসুস্থ ছিলেন। তিনি আল্লাহকে এভাবেই ভয় করতেন।

হজরত ওসমান (রা.):

সায়্যিদুন ওসমান (রা.) এর ব্যাপারে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সায়্যিদা আয়িশা সিদ্দীকা (রা.)-কে বলেছিলেন,

أَلاَ أَسْتَحْيِى مِنْ رَجُلٍ تَسْتَحْيِى مِنْهُ الْمَلاَئِكَةُ

‘হে আয়িশা! আমি কি এমন ব্যক্তিকে দেখে লজ্জা পাব না, যাকে দেখে ফেরিশতারাও লজ্জা পায়?

আরেকবার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন,

اللهم رضيت عنه فارض عنه

‘হে আল্লাহ! আমি ওসমানের প্রতি সন্তুষ্ট। আপনিও ওসমানের  প্রতি সন্তুষ্ট হোন।

যে ওসমান সম্পর্কে নবুওয়্যতের পবিত্র মুখ থেকে এমন সব কথা উচ্চারিত হয়েছে সেই ওসমান বলতেন,

لو وقفت بين الجنة والنار فخيرت بين أن أصير رمادا أو أخير إلى أي الدارين أصير، لاخترت أن أكون رمادا

কেয়ামতের দিন যদি আমাকে সুযোগ দেয়া হয় যে, তোমার হিসাব নিয়ে তোমাকে জান্নাতে বা দোযখে পাঠাব না-কি, হিসাব গ্রহণ ব্যতীতই তোমাকে মাটিতে মিশিয়ে দেব? তবে আমি আল্লাহর কাছে আমার সিদ্ধান্ত জানাব যে, হে আল্লাহ! আমার হিসাব গ্রহণ করবেন না। আমাকে মাটি করে দিন।

এ কথাগুলো সেই ওসমান বলতেন, যেই ওসমানকে দেখে ফেরিশতারাও লজ্জা পেতেন, যার জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পবিত্র হাত রেখে বলেছিলেন, এটা ওসমানের হাত আর এটা আমার হাত।

হজরত আবু দারদা (রা.):

সায়্যিদুনা আবু দারদা (রা.) ছিলেন দামেশকের বিচারপতি এবং সায়্যিদুল কুররা। একবার বন্ধুত্বের সূত্রে হজরত সালমান ফারেসী (রা.) তাকে বলেছিলেন, আপনি নিজের দেহের প্রতি একটু লক্ষ্য রাখুন। হজরত নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও সেই পরামর্শ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন,

يَا أَبَا الدَّرْدَاءِ إِنَّ لِجَسَدِكَ عَلَيْكَ حَقًّا مِثْلَ مَا قَالَ لَكَ سَلْمَانُ

‘হে আবু দারদা! সালমান যেরূপ বলেছে সেরূপ তোমার ওপর তোমার দেহের হক আছে।’

তিনি বলতেন,

لو لا ثلاث ما احببت البقاء ساعة ظمأ الهواجر والسجود فى الليل ومجالسة أقوام ينتقون جيد الكلام كما ينتقى أطايب الثمر

‘তিনটি জিনিস যদি না থাকত তবে বেঁচে থাকার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ থাকত না। যথা: গ্রীষ্মকালে রোজার কারণে পিপাসিত থাকা, রাতে সিজদা করা, আল্লাহর ওলিদের মজলিসে যাতায়াত করা। যেমনভাবে তোমরা ভালো ভালো ফল বেছে নাও সেভাবে মানুষ তাদের কথা গ্রহণ করে।

সাহাবি ও তাবিয়ীনরা তার ব্যাপারে মন্তব্য করতেন,

كان أبو الدرداء من العلماء الحكماء من الذين يشفون

‘আবু দারদা ওই সব আলেম ও হাকিমদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন যাদের থেকে নফসের রুগীরা চিকিৎসা গ্রহণ করত।

তিনি বলতেন,

لئن أستيقن أن الله قد تقبل لى صلاة واحدة أحب إلى من الدنيا وما فيها

‘যদি আমি জানতে পারতাম যে, আল্লাহ তায়ালা আমার একটি নামাজ কবুল করেছেন, তবে তা আমার কাছে দুনিয়া ও দুনিয়ার সব কিছু থেকে প্রিয় হত।

এসব হজরতদের ওপর আল্লাহর ভয় এমন প্রবল ছিল। অথচ আজ আমরা মৃত্যু নিয়ে গাফেল। মৃত্যুর চিন্তা বাদ দিয়ে দিন রাত শুধু দুনিয়ার কথাই ভাবি। হে আল্লাহ! আমাদের মৃত্যু চিন্তা ও মৃত্যুর ভয় উপলব্ধি করার তাওফিক দাও। আমিন।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা