• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

কচুয়া থেকে লন্ডন-আহরার হোসেনের একুশ বছরের সাংবাদিকতা যাত্রা

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ৩ আগস্ট ২০২১  

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বাংলা বিভাগের অনলাইন ও ডিজিটাল কর্মকাণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র জার্নালিস্ট আহরার হোসেনের শৈশব কেটেছে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার খলিশাখালী গ্রামে।

আশির দশকের শেষভাগে যখন তিনি কচুয়া সদরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন তাকে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো পায়ে হেঁটে। এর মধ্যে দুই কিলোমিটার মাটির রাস্তা ধরে যেতে হতো, তারপর নদী পারাপার হতে হতো খেয়া নৌকাযোগে। বর্ষাকালে কখনো কখনো স্কুলে যেতে গিয়ে ছোট মানুষটা ডুবে যেতো কোমর সমান কাঁদার মধ্যে। বইপত্র-জামাকাপড় কাদায় মাখামাখি হয়ে কোন কোনদিন স্কুলেও যাওয়া হয়ে উঠতো না তার। এমন সময়ের কথা বলছি, যখন কচুয়া থেকে বাগেরহাট যেতে পার হতে হতো একটি খেয়া ও একটি ফেরি, খুলনা যেতে আরো একটি ফেরি, আর ঢাকা যেতে পাড়ি দিতে হতো সাতটি ফেরি। এমন পরিবেশে থেকে বড় স্বপ্ন দেখা নিতান্তই সুদূর কল্পনা। কিন্তু সেই স্বপ্নই ওই শৈশবেই দেখে ফেলেছিলেন তিনি। ঔষধ ব্যবসায়ী বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু এদিকে অতি শৈশবেই সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্নে মগ্ন ছিলেন তিনি।

ঢাকার জাতীয় দৈনিক কচুয়ায় পৌঁছাতে দুদিন লেগে যেতো। কিন্তু সেটাই সংগ্রহ করে ওই বয়সেই এমাথা থেকে ওমাথা প্রতিটি খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে ফেলতেন। সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন থেকেই কচুয়াতে দেয়াল পত্রিকা বের করতে থাকেন। নব্বইয়ের দশকে তার সম্পাদিত দেয়াল পত্রিকা ‘কচুয়া বার্তা’ উপজেলা প্রশাসনের নজরও কেড়েছিল। এজন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন একাধিকবার। সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে ‘সম্পাদক’নামেই পরিচিতি ছিল তার। স্বপ্ন তাড়া করার জন্যই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাতালিকার একেবারে শীর্ষ পর্যায়ে থাকার পরও বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা।

আহরার হোসেন বাগেরহাট টুয়েন্টিফোরকে বলেন, “সাংবাদিক হওয়াটাকে আমি পাখির চোখ করে নিয়েছিলাম। আমার আর কোন লক্ষ্য ছিলোনা জীবনে। মেধাতালিকায় দুইশর মধ্যে ছিলাম, চাইলে ইংরেজি, অর্থনীতি কিংবা আইনের মতো বিষয় বেছে নিতে পারতাম। কিন্তু দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই সাংবাদিকতা বেছে নিয়েছিলাম”।

তিনি আরো বলেন, “এজন্য পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন, চেনা-জানা সবার গঞ্জনা সইতে হয়েছে। কিন্তু তাতে পিছপা হইনি। সবাই বলতো, সাংবাদিক হওয়ার জন্য আবার লেখাপড়া করা লাগে নাকি? আমি বলতাম অবশ্যই, যে কোন কিছুতেই দক্ষতা এবং শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনার কোন বিকল্প নেই”।

শিক্ষাজীবনে তিনি সুযোগ পেয়েছেন আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিকী, গোলাম রহমান, আসাদুজ্জামান নূরের ভাই আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী, সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের কন্যা সিতারা পারভীন, সংবাদ পাঠিকা সামিয়া রহমান, নাট্য অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার, সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পুত্রবধু সাবরিনা সুলতানা চৌধুরীর মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তারকা শিক্ষকদের কাছে হাতে কলমে সাংবাদিকতা শিক্ষালাভের। পরবর্তীতে এদের অনেকের সাথেই সহকর্মী হিসেবে কাজও করেছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনের গোড়া থেকেই লেগে পড়েন স্বপ্ন বাস্তবায়নে। প্রথম দিন থেকেই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নানা বিষয়ে প্রতিবেদন লিখতে শুরু করেন ইত্তেফাকের মতো জাতীয় দৈনিকে। ২০০৪ সালে দুমাসের এক শিক্ষানবিশ কর্মসূচীতে যোগদান করেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা সম্পাদক মতিউর রহমানের। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার আগেই দৈনিক প্রথম আলোতে শুরু হয় ওয়েজ বোর্ডের বেতনভুক্ত রিপোর্টার হিসেবে পেশাদার সাংবাদিকতায় পথচলা।

কিন্তু তখন বাংলাদেশে চলছে টেলিভিশন সাংবাদিকতার জোয়ার। টেলিভিশন সাংবাদিক হওয়ার হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেননি তিনি। প্রথম আলো ছেড়ে যোগ দেন তখনকার সময় বাংলাদেশের সবচাইতে জনপ্রিয় বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভিতে। এখানকার সাংবাদিক হিসেবে দেশজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। পরে আরো দুটি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনা ও মাছরাঙার প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু স্বপ্ন তার আরো বড়। ইচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির বাংলা বিভাগের রেডিওর জন্য কাজ করা।

বিবিসিতে কাজ করার সুযোগ আসে ২০১১ সালে। সেখানে শুরু করেন রেডিওর ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে। পরবর্তীতে লিখেছেন ও ভিডিও প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বিবিসির বাংলা ও ইংরেজি ওয়েবসাইটে। সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করেছেন চ্যানেল আইতে প্রচারিত বিবিসির টিভি অনুষ্ঠান ‘বিবিসি প্রবাহ’-তে। এখন সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে ব্যবস্থাপনা করেন বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইট।

প্রায় একুশ বছরের বেশি সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে কাজ করেছেন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকায়, রেডিও, টেলিভিশন, অনলাইন, ডিজিটাল মাধ্যম – বলতে গেলে সাংবাদিকতার সকল প্লাটফর্মে। সংবাদ ও নানাবিধ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কভার করতে ইউরোপ আমেরিকা সহ বিশ্বের নানা দেশে ঘুরেছেন। করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে প্রতি বছর অন্তত একবার গেছেন লন্ডনে – এনবিএইচ বলে পরিচিত বিবিসির সদর দপ্তরে। সেখানে বিশ্বের নানা ভাষাভাষী মানুষের সাথে একসঙ্গে বসে কাজ করার ও নানা প্রশিক্ষণ নেবার সুযোগ হয়েছে তার।

সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে পরপর তিন বার পেয়েছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ‘সেরা সাংবাদিক’সম্মাননা। কচুয়া প্রেসক্লাবের তরফ থেকেও তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে।

কচুয়ার গর্ব আহরার হোসেন স্বপ্ন দেখেন ইউটিউবের মতো বাংলা ভাষার একটি ভিডিও প্লাটফর্ম গড়ে তোলার।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা