• শনিবার ০৪ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২০ ১৪৩১

  • || ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

ডান্সিং প্লেগ: নাচতে নাচতেই মৃত্যু, আজও ইতিহাসের পরম বিস্ময়

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩  

মহামারি! টানা দুই বছর এই শব্দটিকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। সেই সঙ্গে মনের ভেতরে ছোঁয়াচে অসুখের আস্তানা গজিয়ে ওঠা। এখনও ভয় কাটেনি! আবারও যদি এমনটা হয়। এমন ভয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বরং ইতিহাসকে একবার ছুঁয়ে দেখা যাক। এই লেখার বিষয় এমন এক ছোঁয়াচে অসুখ, যার কথা শুনলে প্রথমেই মনে হবে নেহাতই বানানো গল্পকথা। কিন্তু তা তো নয়। অতীতের পৃথিবীর রীতিমতো সত্যি কাহিনি হয়ে আজও ইতিহাসের অংশ হিসেবে রয়ে গিয়েছে এই অভিনব প্লেগের স্মৃতি। ‘ডান্সিং প্লেগ’ নামেই যার পরিচিতি।

প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। ফ্রান্সের স্ট্রসবার্গ শহর। যদিও তখন তা রোমের অধীন। ১৫১৮ সালের জুলাইয়ের প্রবল গরমে সেঁকাপোড়া একটা দিন। হঠাৎই পথে নেমে পড়লেন ত্রোফিয়া। পথই হয়ে উঠল মঞ্চ। নাচের মঞ্চ। নাচতে শুরু করে দিলেন সেই তরুণী। একেবারে অকস্মাৎ! সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। আশপাশে ভিড় জমাতে সময় লাগল না। কিন্তু ত্রোফিয়ার কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি নেচে চলেছেন নিজের মনে। যেন সব আগল ভেঙে, সমস্ত নিয়ন্ত্রণ চুরমার করে নিজের সত্তাকে ভাসিয়ে দেওয়া এক অনন্ত প্রবাহের ভিতরে। নাচতে নাচতে মত্ত ত্রোফিয়াকে ঘিরে এবার একটা অন্য ভিড় জমলো। এঁরা দর্শক নয়, অংশগ্রহণকারী। বেশির ভাগই কমবয়সি মহিলা। তাঁরা নাচতে লাগলেন ত্রোফিয়াকে ঘিরে। চলতে থাকল নাচ।

এমন করে কাটল ৬ দিন! প্রতিটি দিনের শেষে নাচতে নাচতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়তেন ত্রোফিয়া। পা তখন রক্তাক্ত। কিন্তু আবার সম্বিত ফিরে পেতেই শুরু হয়ে যেত নাচ। যেন নাচ ছাড়া এ জীবনে তার আর করণীয় কিছু নেই। একই অবস্থা ভিড়ের বাকিদেরও। তাদেরও অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদ্ভ্রান্তের মতো এই উন্মাদের নৃত্য বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণই দেখা গেল না। কথিত আছে, মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া এই ছোঁয়াচে নাচের অসুখে নাকি সেই সময় গড়ে ১৫ জন করে মানুষ মারা গিয়েছিলেন! শরীরের ওপর অমানুষিক ধকল ডেকে আনতে লাগল স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের মতো অসুখ।

স্বাভাবিকভাবেই এমন পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকতে চায়নি শাসকরা। সংগীতজ্ঞদের ভাড়া করে শহরের টাউন হলে আনা হল। উদ্দেশ্য, বিষে বিষক্ষয়ের মতো মিউজিক শুনিয়ে নাচিয়েদের আরও নাচতে উৎসাহ দেওয়া। কিন্তু তাতেও ফল হয়নি। বরং ক্রমশ বাড়তে থাকে নাচতে থাকা মানুষের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ে মৃতের সংখ্যা!

কিন্তু সত্যিই কি বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই আশ্চর্য অসুখে? সে সম্পর্কে কিছু হলফ করে বলা মুশকিল। স্ট্রসবার্গ শহরের নথি ঘেঁটে দেখা যায় সেখানে মৃতের সংখ্যা কিছু দেওয়া নেই। এমনকি, আদৌ কেউ মারা গিয়েছিলেন কিনা তাও উল্লেখ করা হয়নি। ফলে এই অসুখে মৃতের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা আজও কাটেনি।

তবে ‘ডান্সিং প্লেগ’ কিন্তু মোটেই ইউরোপের প্রথম ও একমাত্র নাচের প্লেগের উদাহরণ নয়। ইএল ব্ল্যাকম্যান তার ‘রিলিজিয়াস ডান্সেস ইন দ্য ক্রিশ্চিয়ান চার্চ অ্যান্ড ইন পপুলার মেডিসিন’ বইতে দাবি করেছেন, ‘ডান্সিং প্লেগ’ প্রথম দেখা যায় সপ্তম শতকে। কোলবিক নামের এক স্যাক্সন শহরে আচমকাই কয়েক নাচতে শুরু করে দেন। তাও আবার কবরখানায়!

সেই শুরু। তারপর থেকে মাঝেমাঝেই এমন নজির মিলেছে। যার মধ্যে সব থেকে ভয়ংকর ১৩৭৪ সালের ঘটনাটি। তার ঠিক আগে গোটা ইউরোপে তাণ্ডব চালিয়েছে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ মহামারি। কার্ল হেকার তার ‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ অ্যান্ড দ্য ডান্সিং ম্যানিয়া’ বইয়ে সবিস্তারে লিখেছেন ১৩৭৪ সালে জার্মানিতে ‘ডান্সিং প্লেগ’-এর প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে। তার বর্ণনায় রয়েছে, ‘‘ওরা সবাই হাত ধরাধরি করে বৃত্ত তৈরি করে নিচ্ছিল। কারও কোনও হুঁশ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নেচে চলেছে।” বেশ কয়েক দিন ধরে চলতে থাকা এই প্লেগে পাঁচশ’ থেকে এগারোশ’ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা যায়। এমন করে অন্তত দশটি নজির লক্ষ করা যায় ইতিহাসে। তবে স্ট্রসবার্গই সবচেয়ে বেশি আলোচিত।

কিন্তু কেন? কোনো কারণে এই অদ্ভুত ব্যামোতে আক্রান্ত হয় মানুষ? এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ট্যারান্টুলা মাকড়সার কামড়ই এমন অদ্ভুত আচরণের পিছনে থাকা আসল কারণ। তবে একই সময়ে একাধিক মানুষের আক্রান্ত হওয়া তাতে যেন ঠিক ‘জাস্টিফাই’ হয় না। তাই ওই তত্ত্ব ধোপে টেকে না। আরেকটা জনপ্রিয় থিয়োরি হল এরগট নামের এক ছত্রাক থেকেই নাকি ছড়িয়েছিল এই অসুখ। রুটির মধ্যে গজায় এই ছত্রাক। কিন্তু এই তত্ত্বও অনেকে উড়িয়ে দেন। তাদের যুক্তি, একসঙ্গে এত বেশি লোকের একই সময়ে ওই ছত্রাকের রাসায়নিকের প্রভাবে আক্রান্ত হওয়াটা অবাস্তব।

এরই পাশাপাশি রয়েছে আরও এক থিয়োরি। সেটা মনস্তাত্ত্বিক। একটু আগে ‘ব্ল্যাক ডেথ’-এর কথা বলা হয়েছিল। সাধারণত এমন মহামারি কিংবা অন্য কোনো সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব মানুষের মনে পড়ে। এক ইতিহাসবিদ জন ওয়ালার এ প্রসঙ্গে তুলে এনেছেন স্ট্রসবার্গের ‘ডান্সিং প্লেগ’-এর প্রেক্ষাপট। তার কথায়, সেই সময় ওখানকার নাটকীয় অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক সংঘাতের আবহ এই অসুখের মঞ্চকে তৈরি করে দিয়েছিল। যার ফলে জন্ম নিয়েছিল এক গণ হিস্টিরিয়া কিংবা সাইকোসিস। হয়তো খিদে, অসুখের দাপট থেকেই এই মানসিক বৈকল্য জন্ম নিয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী, যত বার এই প্লেগ ফিরে এসেছে ততবারই এমন ধরনের পরিস্থিতি ছিল।

এতগুলো শতক পেরিয়ে এসেও মানুষ এই আশ্চর্য অসুখকে ভোলেনি। ভোলেনি স্ট্রসবার্গকে। ‘স্ট্রসবার্গ ১৫১৮’ নামের এক থিয়েটার রয়েছে, যেটির পরিচালনা ও কোরিওগ্রাফি করেছেন লুসি মারিনকোভিচ। গত মাসে নিউজিল্যান্ড ফেস্টিভ্যালেও তা মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেখানে এই অসুখের মধ্যে বিপ্লবের বীজ খোঁজা হয়েছে। যেন নাচের মধ্যে দিয়েই ঝরে পড়েছে প্রতিবাদ। নাচতে নাচতে কেউ অর্ধনগ্ন হয়ে পড়ছেন। কেউ আবার সম্পূর্ণ নিরাবরণ। তবু নাচ চলছে! দারিদ্র, গৃহহীনতা, পিতৃতন্ত্রের কঠোরতার বিরুদ্ধে এক অন্যরকম সপাট বিদ্রোহ। এভাবেই শিল্পীর কল্পনা যেন ইতিহাসকে নতুন করে চিনতে শেখায়, ভাবতে শেখায়।

ছোঁয়াচে অসুখ, মহামারি মানবসভ্যতা কম দেখেনি। এই মুহূর্তেও তো আমরা রয়েছি অতিমারীর মধ্যেই। তবু ‘ডান্সিং প্লেগ’-এর অভিনবত্ব তাকে এক স্বতন্ত্র অধ্যায় করে রেখেছে। কয়েকশো বছর পেরিয়ে এলেও যাকে ঘিরে বিস্ময়ের জলছাপ একই রকমের জ্বলজ্বলে হয়ে আছে।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা