• শনিবার ১১ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৮ ১৪৩১

  • || ০২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

দেশকে বাঁচাতে গিয়ে সুন্দরবনের বুকে এখনও ক্ষতচিহ্ন

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ৯ নভেম্বর ২০২১  

কটকা। মোংলা বন্দর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের অন্যতম অনিন্দ্যসুন্দর অভয়ারণ্য। কটকার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে বনের নদীকে যুক্ত করেছে কাঠের এক লম্বা জেটি। সেই জেটির ওপরই দৌড়াদৌড়ি করছিল বেশ কিছু বানর। কটকা খালে লঞ্চ ভেড়ার পর মাঝারি ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে করে জেটিতে পৌঁছানোর পর মনে হলো, বানরগুলো যেন নেচেগেয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

তবে খানিক পরই দেখা গেল, উদ্যম হারিয়ে নাচগান থামিয়ে বসে পড়েছে বানরের পাল। গাইড জানালেন, ওরা হয়তো ভেবেছিল, অতিথিরা কোনো খাবার নিয়ে আসবেন! সে আশায় গুড়েবালি দেখে হতোদ্যম হয়ে পড়েছে বানরের পাল। অবশ্য বনে বা বনাঞ্চলে কোনো বন্যপ্রাণিকুলকে বাইরের খাবার সরবরাহে এক ধরনের বিধিনিষেধ রয়েছে। তবু সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কেউ কেউ টুকটাক খাবার দেয় বানরদের। এতে ওদের অভ্যাসও খারাপ হয়ে গেছে।

জেটি পেরিয়ে ওপরে উঠলেই এক পাশে বন বিভাগের কার্যালয়। তার পাশেই আবার সুপেয় পানি ধরে রাখার জন্য বড় দুটি পুকুর। এর পানি এতটাই স্বচ্ছ যে, পুকুরের নিচে মাছের চলাচলও স্পষ্ট দেখা যায়। এই পুকুরের মিঠা জল ব্যবহার করেন আশপাশে বন বিভাগে কর্মরত লোকজন ও জেলেরা। অনেক সময় বনের প্রাণিকুলও এখানে গলায় ভেজায়। একটু সামনে এগোলেই কাঠের তৈরি লম্বা পুল। সেটি পেরোলেই চোখে পড়ে ছোট্ট নির্জন ও পরিচ্ছন্ন সমুদ্রসৈকত; বেলাভূমিজুড়ে কাঁকড়াদের শিল্পকর্ম আর কারুকাজ।

কটকার একটি বড় অংশ এখনও সুন্দরবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতচিহ্ন ধরে রেখেছে। এখানকার ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদের শ্বাসমূল বালুতে ঢেকে গেছে। সারি সারি মরা ও অর্ধমৃত গাছ। ডালপালা শুকিয়ে গেছে এমন কিছু বৃক্ষ উপড়ে পড়ে আছে। শ্বাসমূল বালুতে ঢেকে যাওয়ায় সুন্দরবনের ওই অংশটুকু দেখলে মনে হয়, বিশাল খোলা ফুটবল মাঠ। আপাতত সেখানে শ্বাসমূল থেকে নতুন গাছ জন্মানোর কোনো লক্ষণ নেই।

দক্ষিণে কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখা মেলে তিনটি উঁচু জায়গার। এ জায়গাটি পরিচিত 'টাইগার টিলা' হিসেবে। অনেকে আবার বলে থাকেন 'বাঘের খাবার টেবিল'। জনশ্রুতি এমন- বাঘ তার খাবার ধরে এনে টিলার ওপর আয়েশ করে খায়। তবে বাঘ সেই টিলায় বসে খাচ্ছে- এমন দৃশ্য দেখেছেন, এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি ওই এলাকায়। টাইগার টিলা থেকে সামান্য পশ্চিমে বয়ার খাল। এই এলাকা নানা পাখির কলকাকলিতে মুখর।

আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে বন বিভাগের আট কর্মী কটকায় দায়িত্ব পালন করছেন। মান্নান বললেন, আইলা, সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলোচ্ছ্বাসের সময় সুন্দরবনের কটকায় বালু বনের ভেতর উঠে আসায় বৃক্ষরাজির শ্বাসমূল ঢেকে গেছে। ওই বালু আর প্রাকৃতিকভাবে সরে যায়নি। সরানোও সম্ভব হয়নি। ফলে গাছগুলো ধীরে ধীরে মারা যায়। বড় ধরনের দুর্যোগে বারবার সুন্দরবন তার বুক এগিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করে।

সুন্দরবনের কটকা বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন। মান্নান জানালেন, কটকার একদিকে দুধমুখী নদী, আরেক দিকে বলেশ্বর ও শ্যালা নদী। বছরের একটি সময় এখানে পর্যটকরা আসেন। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যটকদের যাতায়াত বেশি। তবে সারা বছরই বন বিভাগের কর্মীরা অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করেন সেখানে। ৩১ বছরের চাকরি জীবনে মান্নান কখনও বাঘের দেখা পাননি। তবে কয়েকবার বাঘের গর্জন শুনেছেন।

মান্নান জানান, সুন্দরবন এলাকায় একাধিকবার জলদস্যুদের কবলে পড়েছেন তিনি। ২০১৩ সালে জেলের নৌকায় কোকিলমনিতে যাচ্ছিলেন। দস্যুরা হঠাৎ নৌকা আটকায়। এরপর বন বিভাগের কর্মীর পরিচয় জানতে পেলে জলদস্যুদের দলনেতা তার সাঙ্গোপাঙ্গদের উদ্দেশে বলেন, সাহেবকে ঠিকঠাক তার জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হবে।

বন বিভাগের বোটম্যান মো. আনছার উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় কটকায়। তিনি জানান, সুন্দরবনের এই অংশে বানর ছাড়াও প্রায় নিয়মিত হরিণ ও শূকরের দেখা মেলে। হরিণের দল অনেক সময় বন থেকে বেরিয়ে নদী ও সমুদ্রের তীর পর্যন্ত চলে আসে। আনসারের সঙ্গে কথা বলার মধ্যেই দেখা গেল, দুটি হরিণ দৃষ্টিসীমার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছে। কিছু সময় পর আরও কয়েকটি হরিণ এসে যোগ দিল ওদের সঙ্গে।

বন বিভাগের আরেক বোটম্যান মো. সুলতান জানান, বন বিভাগের যে কয়েকজন কর্মী কটকায় নিয়োজিত, তাদের দু'জনের কাছে চায়নিজ রাইফেল রয়েছে। রাইফেলে বলতে গেলে সব সময়ই গুলি লোড করা থাকে। তবে গত পাঁচ মাসে গুলি ব্যবহার করার মতো কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়নি।

কটকার ফরেস্ট গার্ড শেখ খায়রুল ইসলামের গল্প অন্যরকম। চলতি বছরের জুন মাসে কটকায় হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে। সেখানে পরীক্ষার পর ২৭ জুন জানা যায়, করোনায় আক্রান্ত তিনি। খায়রুল বললেন, জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আগে গ্রাম থেকে ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে ফিরেছিলেন তিনি। কে জানে, হয়তো তখনই গ্রামের কারও কাছ থেকে সংক্রমিত হয়েছিলেন।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা