• বুধবার ১৫ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩১

  • || ০৬ জ্বিলকদ ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

স্বদেশ ভাবনা: সমঝোতাই কাম্য

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ৮ নভেম্বর ২০১৮  

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সৃষ্ট সংকট নিরসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে বহু কাক্সিক্ষত সংলাপ ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে সংলাপে নেতৃত্ব দেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দল বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব দেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। সংলাপের ফলাফল নিয়ে দু’পক্ষ মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।

সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বলা হয়, সংলাপে খোলামেলা আলোচনা এবং কিছু কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, সীমিত পরিসরে সংলাপ অব্যাহত থাকবে। ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা সংলাপে সন্তুষ্ট নন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনুরোধে আজ (৭ নভেম্বর) দু’পক্ষ আবার সংলাপে বসবে। তাদের মধ্যকার সংলাপ সফল হোক- এটাই জনগণের প্রত্যাশা। কারণ রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রধান দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা না হলে তার ফলাফল কী ভয়াবহ হয়, জনগণ ইতিপূর্বে তা একাধিকবার দেখেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দাবিগুলো পর্যালোচনা এবং উভয়পক্ষের মধ্যকার সংলাপে সমঝোতা কেন প্রয়োজন, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও দফায় দফায় বৈঠকের পর ১৩ অক্টোবর রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের ঘোষণা আসে। ঘোষণা দেন ড. কামাল হোসেন। সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য পাঠ করা হয়। এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগকে একটি অর্থবহ সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে ২৮ অক্টোবর একটি চিঠি দেন ড. কামাল হোসেন।

তিনি তার চিঠিতে বলেন, ‘ইতিবাচক রাজনীতি একটি জাতিকে কীভাবে ঐক্যবদ্ধ করে জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারগুলো আদায়ের মূল শক্তিতে পরিণত করে, তা বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়েছেন। নেতিবাচক রুগ্ন রাজনীতি কীভাবে আমাদের জাতিকে বিভক্ত ও মহাসংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তাও আমাদের অজানা নয়। এ সংকটের উত্তরণ ঘটানো আজ আমাদের জাতীয় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। একটি শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সবার অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি অর্থবহ সংলাপের তাগিদ অনুভব করছে এবং সে লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ প্রত্যাশা করছি।’

চিঠির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য সংযুক্ত করা হয়। জাতীয় সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল এবং আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সঙ্গে এ পর্যন্ত সংলাপে যেতে অস্বীকৃতি জানালেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আবরণে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়ে আওয়ামী লীগ উদারতার পরিচয় দিয়েছে। আজকের সংলাপে সমঝোতা না হলে সংলাপের সময় বৃদ্ধি করে সমঝোতায় পৌঁছানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। সমঝোতা হলে আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন যে বাড়বে, তা অনেকটা জোর দিয়েই বলা যায়।

এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা দাবি পর্যালোচনা করা যাক। প্রথম দফায় অন্তর্ভুক্ত দাবিগুলোর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত দাবিটি সম্পূর্ণভাবে আদালতের এখতিয়ারাধীন। তাই আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার উদ্যোগ ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপিকে নিতে হবে। এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেতে চাইলে বিএনপি নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। সরকারি দলের এ প্রস্তাব জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না।

এ দফার অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে দুটি প্রস্তাব- জাতীয় সংসদ বাতিল এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন সংবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো প্রস্তাব আলোচনা করে লাভ হবে না মর্মে আওয়ামী লীগ নেতারা একাধিকবার জানিয়েছেন। ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলেছেন, সংবিধান মেনেই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। উল্লেখ্য, সংসদীয় সরকার পদ্ধতি চালু রয়েছে পৃথিবীর এমন কোনো দেশে নির্বাচিত সংসদ বহাল রেখে নতুন সংসদ নির্বাচনের নজির নেই। তাই গত বছর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের অধিকাংশ প্রতিনিধি সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন সংসদ নির্বাচনের সুপারিশ করেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উচিত হবে- এ দাবিটি মেনে নেয়া।

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের বিষয়টি দু’পক্ষ খোলা মন নিয়ে আলোচনা করে সমাধান খুঁজে বের করতে পারে। দ্বিতীয় দফায় দুটি বিষয়ের একটি হল, নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার সম্পর্কিত। এখানে যে বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার, তা হল- গত বছর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনায় নির্বাচনী মঞ্চের কুশীলব রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। আলোচনায় অন্যান্য অংশীজনের মধ্যে যাদের মতামত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে, সেই নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা পরোক্ষভাবে ইভিএম ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করেন (সূত্র : নির্বাচনী সংলাপ ২০১৭, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন)।

নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ রেখে সম্প্রতি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করা হয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতেই হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও আসন্ন সংসদ নির্বাচনে সীমিত আকারে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। কারণ এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কমিশনকে কোনো নির্দেশনা দেয়া সম্ভব হবে না। মেয়াদ বহাল থাকাবস্থায় নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের নজির থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতি কাছে বিধায় এ মুহূর্তে কমিশন পুনর্গঠনের দাবি বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। তৃতীয় দফায় অন্তর্ভুক্ত প্রথম দাবিটির মধ্যে রয়েছে বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

১ নভেম্বরের সংলাপ শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান- ‘প্রধানমন্ত্রী তাদের পরিষ্কার বলে দিয়েছেন সভা, সমাবেশ ও মতপ্রকাশে কোনো বাধা দেয়া হবে না’ (যুগান্তর, ২ নভেম্বর)। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণের দাবিটির সঙ্গে সরকারি দল একমত পোষণ করেছে বলে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এ দুটি দাবি পূরণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। চার দফায় উল্লিখিত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সাংবাদিকদের আন্দোলন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মতপ্রকাশের অভিযোগে ছাত্রছাত্রী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবি পূরণে সরকারের নমনীয় মনোভাব নেয়া উচিত হবে। এ মর্মে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হবে মর্মে ঐক্যফ্রন্টকে আশ্বস্ত করা উচিত।

পঞ্চম দফায় অন্তর্ভুক্ত দাবি হল- নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্তকরণ। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ক্ষমতা প্রদান ছাড়া এ দফার সব দাবি পূরণের ক্ষমতা সংবিধান ও আরপিও নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছে। সেনাবাহিনী নিয়োগ প্রশ্নে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইতিমধ্যেই বলেছেন- ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি। কেউ চাইল বা না চাইল- তার ওপর নির্ভর করে কিছু হবে না। পরিবেশ পরিস্থিতিতে যদি প্রয়োজন মনে করি, সবই করব। দরকার মনে না করলে সেনাবাহিনী আসবে না। এটা সম্পূর্ণভাবে ইসির ওপর ছেড়ে দিতে হবে।’ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করার দাবি করা হয়েছে ষষ্ঠ দফায়। সরকারি দল এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে বলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিতকরণ এবং কোনো ধরনের নতুন মামলা না দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদানের সাত নম্বর দফার দাবিটি সরকারি দল আওয়ামী লীগের মেনে নেয়া উচিত। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য এটি প্রয়োজন।

টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অব্যাহত গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হল সুষ্ঠু নির্বাচন। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করতে বিবদমান রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সমঝোতা হতে হবে। সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য সরকারি দলকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিরোধী দল বা গোষ্ঠীকেও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সমঝোতা না হলে দেশের গণতন্ত্র ও অর্থনীতি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়- জনগণ তা ১৯৯৫, ২০০৬, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে দেখেছে। তারা সেটার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না। আগামীতে সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলুক- এটাই জনগণের প্রত্যাশা।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা