• বুধবার ০৮ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

  • || ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

হজ বা ইবাদতের উদ্দেশে সফরে করণীয়

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ২৪ জুন ২০২১  

যে কোনো সফরের রয়েছে নির্ধারিত কিছু নিয়ম-পদ্ধতি ও আদব। কিন্তু এ সফর যদি হয় হজ কিংবা ইবাদতের উদ্দেশে তবে সফরকারীর জন্য রয়েছে বেশ কিছু আদব-নিয়ম ও করণীয়। কী সেই সব আদব-নিয়ম ও করণীয়?

পরিবার-পরিজন ও জন্মভূমি ত্যাগ করে দূরে কোথায় যাওয়ার নাম সফর। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যভেদে সফর অনেক রকমের হতে পারে। তা হতে পারে দ্বীনের জন্য আবার হতে পারে দুনিয়ার জন্য। তাই মানুষের সফরের উদ্দেশ্য যেমন হবে, তার সফরের হুকুম-বিধান এবং সফরের প্রাপ্তি ও প্রতিদানও সে রকম হবে।

অবস্থাভেদে সফর হয় ৩ ধরনের। তাহলো- সাওয়াবের সফর, বৈধ সফর এবং অবৈধ সফর। যেমন-

১. সফর যদি ইবাদতের উদ্দেশে হয়; তবে তা সাওয়াব হিসেবে পরিগণিত হবে। তাহলো- হজ, ওমরাহ কিংবা আল্লাহর কাজে জেহাদ বা কল্যাণের কাজে সর্বাত্মক প্রচেষ্টার সফর।

২. সফর যদি বৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য হয়; তবে তা বৈধ সফর হিসেবে গণ্য হবে। আর বৈধ ব্যবসার কাজে সফর করা বৈধ।

৩. যে কোনো হারাম কাজের উদ্দেশে সফর করাও হারাম বা অবৈধ। যেমন যে কোনো পাপ বা অন্যায় বা জুলুম করার উদ্দেশে সফর।

হজ বা ইবাদতের সফরের করণীয়

হজ, ওমরাহ কিংবা ইবাদতের সফরে রয়েছে কিছু করণীয়। যা মেনে সফর করার নির্দেশ দেয় ইসলাম। তাহলো-

১. সফরের নিয়তের বিশুদ্ধতা

হজ, ওমরাহ কিংবা ইবাদতের উদ্দেশে সফর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে বিশুদ্ধ নিয়তে হতে হবে। এ সফরের যাবতীয় কথা, কাজ এবং ব্যয় সব কিছুতেই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য থাকতে হবে। নিয়তে বিশুদ্ধতা থাকলে ওই ব্যক্তির জন্য থাকবে-

> সাওয়াব বা নেকির নিশ্চয়তা।

> গোনাহ মাফের নিশ্চয়তা এবং

> মর্যাদা বৃদ্ধির নিশ্চয়তা।

প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিসের দিকে লক্ষ্য করলেই তা বুঝা যায়। তাহলো-

হজরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উদ্দেশ্য করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন-

وَإِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللَّهِ إِلَّا أُجِرْتَ بِهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِي فِي امْرَأَتِكَ

‘তুমি যে কোনো খরচে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা কর; তবে তাতে তোমাকে তার নেকি বা প্রতিদান দেওয়া হবে। এমন কি যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দেবে তাতেও নেকি বা প্রতিদান রয়েছে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

২. সফরে হালাল-হারাম মেনে চলা

আল্লাহ তাআলা যেসব কথা ও কাজ হালাল করেছেন তা মেনে চলা এবং যেসব কথা ও কাজ হারাম করেছেন তা থেকে বিরত থাকা। চাই তা ঘরে অবস্থানের সময় হোক কিংবা সফরে। যেমন-

> সফরের সময় যেখানে নামাজের সময় হবে, সেখানে (সম্ভব হলে) জামাআতে (৫ ওয়াক্ত) নামাজ আদায় করা।

> সফরের সময় নিজ নিজ সফরসঙ্গীদের কল্যাণ কামনা করা।

> সফরের সময় অবস্থা ও অবস্থানভেদে সৎ কাজের উপদেশ এবং অন্যায় কাজে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি কৌশলের সঙ্গে উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা।

> হারাম কথা ও হারাম কাজ হতে বিরত থাকা। তা হতে পারে মিথ্যা, গীবত (পরনিন্দা), চুগোলখোরী, প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতাসহ আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণের অন্যান্য সব কাজ থেকে বেঁচে থাকা।

৩. সফরে দোয়া ও জিকিরের আমল করা

সফরের শুরুতে ও সফরকালীন সময়ে হাদিস থেকে প্রমাণিত দোয়া এবং জিকিরের আমল করা। আর তাহলো-

> সফরের আগের দোয়া

সফরে বের হওয়ার আগে নিজের পরিবার, প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ পরিচিতদের কাছ থেকে বিনম্রভাবে বিদায় নেওয়া। তারপর একে অপরের জন্য এ দোয়াটি পাঠ করবেন-

أَسْتَوْدِعُ اللهَ دِيْنَكُمْ وَ أَمَانَتَكُمْ وَ خَوَاتِيْمَ أَعْمَالِكُمْ

উচ্চারণ : আসতাউদিয়ুল্লাহা দিনাকুম ওয়া আমানাতাকুম ওয়া খাওয়াতিমা আ’মালিকুম।’

অর্থ : আমি আপনার দ্বীন, আপনার আমানতসমূহ ও আপনার শেষ আমলসমূহকে আল্লাহর জিম্মায় ন্যস্ত করলাম।’ (আবু দাউদ, মিশকাত)

> বিদায় দেওয়ার সময় আত্মীয়-স্বজনরা বলবেন-

زَوَّدَكَ اللهُ التَّقْوَى وَ غَفَرَ ذَنبك وَ يَسَّرَلَكَ الْخَيْرَ حَيْثُ مَا كُنْتَ

উচ্চারণ : ‘যাওয়্যাদাকাল্লাহুত তাক্বওয়া ওয়া গাফারা জাম্বাকা ওয়া ইয়াস্সারা লাকাল খায়রা হাইছু মা কুংতা।’

অর্থ : আল্লাহ আপনাকে তাক্বওয়ার পুঁজি দান করুন! আপনারগোনাহ মাফ করুন এবং আপনি যেখানেই থাকুন আপনার জন্য কল্যাণকে সহজ করে দিন।’ (তিরমিজি, মিশকাত)

> বাড়ি থেকে বের হওয়ার দোয়া

بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلِى اللهِ وَ لَا حَوْلَ وَ لَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللهِ

উচ্চারণ : ‘বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহি ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ।’

অর্থ : আল্লাহর নামে (বের হচ্ছি), তাঁর উপরে ভরসা করছি। আল্লাহ ছাড়া কোনো ক্ষমতা বা শক্তি নেই।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, মিশকাত)

> যানবাহনে (গাড়ি-বিমানে) উঠতে দোয়া পড়া

শুরুতেই بِسْمِ الله ‘বিসমিল্লাহ’ বলে গাড়ি বা বিমানের সিঁড়িতে পা দেওয়া। তারপর উপরের দিকে উঠতেই اَللهُ اَكْبَر ‘আল্লাহু আকবার’ বলা এবং সিটে বসে اَلْحَمْدُ للهِ ‘আলহামদুল্লিাহ’ বলা। তারপর যানবাহন চলতে শুরু করলেই ৩ বার اَللهُ اَكْبَر আল্লাহু আকবার বল। অতঃপর (সম্ভব হলে) এ দুইটি দোয়া পড়া-

> سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُون اللَّهُمَّ إِنِّا ْنَسألُكَ فِي سَفَرِنَا هَذَا البِرَّ وَ التَّقْوَى ، وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى ِ اَللَّهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفرِنَا هَذَا وَاطْوِلَنَا بَعْدَه ، اَللَّهُمَّ أنْتَ الصَّاحِبُ فِيْ السَّفَرِ وَ الْخَلِيْفَةُ فِيْ الْأَهْلِ وَ الْمَالِ ، اَللَّهُمَّ اِنِّى أَعُوْذُبِكَ مِنْ وَعْثَاء السَّفَرِ وَ كَابَةِ الْمَنْظَرِ وَ سُوْىِ الْمُنْقَلَبِ فِى الْمَالِ وَ الأَهْلِ

উচ্চারণ : সুবহানাল্লাজি সাখখারা লানা হাজা ওয়া মা কুন্না লাহু মুক্বরিনিনা ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুংক্বালিবুন। আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফি সাফারিনা হাজাল বির্রু ওয়াত ত্বাকওয়া, ওয়া মিনাল আমালি মা তারদা, আল্লাহুম্মা হাওয়্যেন আলাইনিা সাফারিনা হাজা ওয়াত্বওয়ে লানা বা’দাহু, আল্লাহুম্মা আনতা ছাহিবু ফিস সাফারি ওয়াল খালিফাতু ফিল আহলি ওয়াল মালি, আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন ও’ছায়িস সাফারি ওয়া কাবাতাল মানজারি ওয়া সুয়িল মুনকালাবি ফিল মালি ওয়াল আহলি।’ (মুসলিম)

>  اللهُ أكْبَر، اللهُ أكْبَر، اللهُ أكْبَر، سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ ، وَإنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ . اللّهُمَّ إنا نسألكَ في سفرنا هذا البرّ والتَّقوى ، ومنَ العملِ ما ترضى ، اللَّهُمَّ هَوِّن عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا ، وَاطْوِ عَنَّا بُعْدَهُ . اللَّهُمَّ أنْتَ الصَّاحِبُ في السَّفَرِ ، والخَلِيفَةُ في الأهْلِ . اللَّهُمَّ إنِّي أعُوذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ ، وَكَآبَةِ المَنْظَرِ وَسُوءِ المُنْقَلَبِ في المالِ وَالأَهْلِ

উচ্চারণ : ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাজি সাখখারা লানা হাজা, ওয়া মা কুন্না লাহু মুক্বরিনিন, ওয়া ইন্না ইলা রব্বিনা লামুংক্বালিবুন। আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্আলুকা ফী সাফারিনা হাযাল বিররা ওয়াত্তাক্বওয়া, ওয়া মিনাল আমালি মা তারদা। আল্লাহুম্মা হাওয়িন আলাইনা সাফারানা হাজা, ওয়াত্‌য়ি আন্না বুদাহু। আল্লাহুম্মা আন্তাস্ সাহিবু ফিস্‌সাফারি। ওয়াল খলিফাতু ফিল আহলি। আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন ওয়া-সায়িস সাফারি, ওয়া কাবাতিল মানজারি, ওয়া সুয়িল মুনক্বালাবি ফিল মালি ওয়াল আহলি।’

অর্থ : ‘আল্লাহ সর্বাধিক মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ সর্বাধিক মহান। আমি পবিত্রতা ঘোষণা করি তাঁর; যিনি, এগুলোকে আমাদের (ব্যবহারের) জন্য বশীভূত করে দিয়েছেন অথচ আমরা এগুলোকে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না। আর আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের দিকে ফিরে যেতে হবে।

হে আল্লাহ! আমরা আমাদের এই সফরে আপনার কাছে সৎ কর্ম ও পাপমূক্ত জীবন কামনা করি এবং এমন কাজ-কর্ম কামনা করি যাতে তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাও।

হে আল্লাহ! আমাদের জন্য এই সফরকে সহজ করে দাও এবং তার দূরত্ব সঙ্কুচিত করে দাও।

হে আল্লাহ! তুমি সফরের সঙ্গী এবং পরিবারে স্থলাভিসিক্ত।

হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে সফরের কষ্ট হতে, খারাপ দৃশ্য দর্শন হতে এবং ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজনের অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে আশ্রয় গ্রহণ করছি। (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ)

> নির্ধারিত গন্তব্যে গিয়ে যানবাহন থেকে নামতে এ দোয়া পড়া-

أَعُوْذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ

উচ্চারণ : ‘আউজু বি-কালিমাতিল্লাহিত তাম্মাতি মিন শাররি মা খালাকা।’

অর্থ : ‘আল্লাহর সৃষ্টবস্তুসমূহের অনিষ্টকারিতা থেকে আমি তাঁর পূর্ণ বাক্যসমূহের মাধ্যমে আশ্রয় চাই।’

> পুনরায় বাড়ি ফেরার দোয়া

সফর শেষে মক্কা-মদিনা কিংবা নির্ধারিত গন্তব্য থেকে ফেরার পথে ৩বার اَللهُ اَكْبِر আল্লাহু আকবার বলে এ দোয়া পড়া-

لَا إلهَ إلاَّ اللَّه وحْدهُ لاَ شَرِيكَ لهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُو عَلَى كُلِّ شَيءٍ قَدِيرٌ – أَيِبُوْنَ تَائِبُوْنَ عَابِدُوْنَ سَاجِدُوْنَ لِرَبِّنَا حَامِدُوْنَ – صَدَقَ اللهُ وَعْدَهُ وَ نَصَرَ عَبْدَهُ وَ هَزَمَ الأَحْزَابَ وَحْدَهُ-

উচ্চারণ : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদির। আয়িবুনা তায়িবুনা আবিদুনা সাজিদুনা লি-রাব্বিনা হামিদুন। সাদাকাল্লাহু ওয়া’দাহু ওয়া নাসারা আব্দাহু ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদাহু।’ (বুখারি ও মুসলিম) 

> সফর শেষে নিজ ঘরে প্রবেশ করার দোয়া

সফর থেকে ফিরে ঘরে প্রবেশ করতে بِسْمِ الله ‘বিসমিল্লাহ’ বলবেন এবং ঘরের লোকজনদের উদ্দেশে সালাম দেবেন।

উল্লেখ্য যে, সফর থেকে ফিরে প্রথমেই পাশ্ববর্তীমসজিদে গিয়ে দুই রাকাআত নামাজ পড়েই ঘরে প্রবেশ করা উত্তম।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হজ-ওমরাহসব সব সফরে উল্লেখিত দোয়া ও তাসবিহগুলো যথাযথ আদায় করে হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা