• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

ষাট গম্বুজ বার্তা

বাংলাদেশের শিক্ষার প্রত্যাশিত মান ও বাস্তবতা

ষাট গম্বুজ টাইমস

প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর ২০১৯  

আশরাফুল আযম খান
শিক্ষার মান একটি ব্যাপক ও সামগ্রিক ব্যাপার। কোন দেশের শিক্ষার মান কেমন হবে তার প্রধান শর্ত হলো শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত অবকাঠমো-সুযোগসুবিধা, শিক্ষকদের পাঠদানের যোগ্যতা, পাঠদানের বিষয়বস্তু অর্থাৎ পাঠ্যক্রম, পাঠদানের পদ্ধতি, মূল্যায়নপদ্ধতিসহ সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা। তাই এ সবকে পাশ কাটিয়ে স্বল্প পরিসরে শিক্ষার মান নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ও ব্যাখ্যাপ্রয়াসী আলোচনা সম্ভব নয়। তদুপরি কোনো দেশের শিক্ষা পরিস্থিতির ওপর সাধারণ নজর দিলেও সে দেশের শিক্ষার মানের অবস্থাটি সহজে বুঝতে পারা যায় ।

স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হলেও এর মান সম্পর্কে রয়েছে গভীর অসন্তুষ্টি ও দ্বিধা। এ সময়ে শিক্ষার হার ও পাশের হার বাড়লে আমরা শিক্ষার মানের বৃদ্ধি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারছি না। এর প্রধান কারণ- বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট জাতীয় লক্ষ্য কী হবে?- তা আমরা দীর্ঘ সময়েও সুনির্দিষ্ট করতে পারিনি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় কুদরত-ই-খুদা শিক্ষার কমিশন হতে শুরু করে বর্তমান সময়ের কবীর চৌধুরীর শিক্ষানীতিতে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ষোষণা থাকলেও আমরা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে সে লক্ষ্যে ঢেলে সাজাতে পারিনি। শিক্ষাকাঠামোর নানামুখী স্ববিরোধিতায় বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষার ব্যবস্থা লক্ষ্যহীন তরীর মতো উদভ্রান্ত। বিভ্রান্তির এই শিক্ষাব্যবস্থার কারণে জাতীয় ভাবমানসের নানামুখী বিরোধী প্রবণতাগুলোকে আমরা ঐক্যমুখী করতে পারছি না। দেশের সমস্যা, নীতি ও অগ্রগ্রতি সম্পর্কে অভিন্ন মত সৃষ্টি করা এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্ভব হচ্ছে না। জীবন ও জগত সম্পর্কে বস্তুনির্ভর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী, দেশের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অভিন্ন মনোভাব, মানবপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ, ব্যক্তির স্বার্থের চেয়ে সমষ্টিগত স্বার্থপ্রতিষ্ঠার চেতনা, কুসংস্কারমুক্ত উদারনৈতিক মনোভূমি আমাদের শিক্ষার ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারেনি। বৃটিশ প্রবর্তিত কেরানি তৈরির শিক্ষার অথবা ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’ এই সংকীর্ণ স্বার্থবাদিতা আজ শিক্ষার মূল উপজীব্য। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় দেশের ধনী-গরিব বৈষম্য, গ্রাম শহরের বৈপরীত্য, নারী পুরুষের সমতা বিধানসহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে জাতিগঠনের অভিন্ন প্রয়াসের সাথে যুক্ত করতে পারেনি। দেশের সাধারণ মধ্যবিত্তের জন্য বাংলা মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার ধারা, উচ্চবিত্ত শ্রেণির জন্য ইংরেজিনির্ভর পাশ্চাত্যমুখী শিক্ষার ধারা ও সমাজের নিন্মবর্গের গরিব মানুষের জন্য ধর্মকেন্দ্রিক মাদ্রাসা শিক্ষাধারা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে শুধু ব্যাহত করেনি বরং এদেশের জনগণের বিভেদ আর বৈষম্যের নীতিকে উস্কে দিয়েছে।

 বাংলাদেশ সরকার সংবিধান দ্বারা একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান ও নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাধ্য। এটি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কর্তব্য। এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সকল নাগরিককে উদ্যোগী ও উদ্যমী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষার কেবল পরিসংখ্যান বা পরিমাণগত উন্নয়নকে গুরুত্ব দিলে হবে এর মানগত দিকটি বরং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। 

এ গেল শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের প্রশ্ন। এটিকে বাদ দিলেও শিক্ষার মানের সংকট সাম্প্রতিককালে ব্যাপক আলোচিত বিষয়। পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি তথা পাবলিক পরীক্ষায় সিংহভাগ বা শতভাগ পাশসহ জিপিএ ৫ প্রাপ্তির এক মহোৎসব শুরু হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। এতে আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে সচেতন মহল এতে গভীর আশংকাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এইচএসসিতে সকল বিষয়ে জিপিএ ৫ পেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় মেধাবী সার্টিফিকেট পাওয়া বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী ন্যূনতম পাশ নম্বর অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ইংরেজি তো পরের কথা নিজের মাতৃভাষায় এরা ন্যূনতম বুৎপত্তি অর্জন করতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা পঠিতব্য বিষয় ঠিক মতো শিখছে কি না, শিক্ষক-অভিভাবকের কাছে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থী বা সন্তানের ভালো ফল। গবেষণা বলছে, বর্ণমালা না শিখেই অনেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠছে।পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে মাত্র এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী বাংলায় এবং এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী গণিতে দক্ষতা অর্জন করছে। এ অবস্থাদৃষ্টে শিক্ষার মানের অবস্থা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। অথচ আমরা একের পর এক পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়েই চলছি। এরই মাঝে বিগত বছরগুলোতে প্রায় প্রত্যেকটি পাবলিক পরীক্ষায় উপর্যুপরি প্রশ্নফাঁসের ঘটনা সন্তানদের নিয়ে সচেতন অভিভাবকদের দারুণ দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছে। যদিও গত দু’এক বছরে তা কিছুটা রোধ করা গেছে বলে সাময়িক স্বস্তি হলেও জাতির মেধাকে হত্যা করার এই ঝুঁকি হতে আমরা এখনও যে মুক্ত হতে পেরেছি তা বলা যাবে না।

অভিযোগ রয়েছে, যে শিক্ষকগণ বোর্ডের খাতা মূল্যায়ন করেন তাঁদের প্রতি মৌখিক নির্দেশ থাকে পাশের হার বাড়ানোর জন্য যতটা সম্ভব ছাড় দিয়ে খাতা দেখতে হবে। গ্রেস নম্বর দিয়ে হলেও শিক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দিতে হবে। এতে পাশ বাড়লেও দেশে যে শিক্ষার মানের চরম অবনমন ঘটছে তা আমাদের নীতি নির্ধারকগণ দেখছেন না। পাঠ্যপুস্তকের পৃষ্ঠা থেকে অধিত বিদ্যা শিক্ষার্থীর তাত্তিক জ্ঞানকে বৃদ্ধি করছে; কিন্তু বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ ঘটাতে পারছে না। অর্থাৎ প্রায়োগিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সাফল্য আসছে না। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা বাংলাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ইংরেজিকে অনেকটাই গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়েছে। অন্যদিকে মাতৃভাষা যে ভালো জানছে তাও নয়।

ব্যক্তির উন্নতির পাশাপাশি সমাজ বা দেশসেবার যে মহান ব্রত শিক্ষার থাকার কথা তা দিনে দিনে গৌণ হয়ে পড়ছে। ‘শিক্ষার জন্য এসো সেবার জন্য যাও’ এ স্থলে শিক্ষা মুনাফা লাভের অথবা কেবল জীবিকা অর্জনের উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ফাঁদে পড়ে, চটকদার মনোহারী বিজ্ঞাপন দেখে অনেক অভিভাবক প্রতারিত হচ্ছেন। অভিভাবকদের অভিযোগ- স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা চান ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের কাছে প্রাইভেট পড়ুক। এ জন্য শিক্ষকেরা শ্রেণিকক্ষের বা পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর দেওয়া, মুখ চিনে নম্বর প্রদান, বিভিন্নভাবে ফেল করে দেওয়ার ভয়ভীতি প্রদান করে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, গণিত শিক্ষক ক্লাসে খাতা ছুড়ে ফেলে দেন, নিজের নিয়ম মতো অংক না করলে অংক হলেও নম্বর দেন না। ইংরেজি শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকালে শিক্ষার্থীদের কাছে বোধগম্য করে তোলার পরিবর্তে বিষয়ের কাঠিন্যকে বড় করে তুলে প্রাইভেট থেরাপি অত্যাবশ্যক করে তুলেন। এ কাজে ড্রয়িং শিক্ষক থেকে বাংলার শিক্ষক কেউ বাদ যান না। অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাকে কোচিংমুখী করার উদ্দেশ্যে আবর্জনাতুল্য একাধিক বই ইচ্ছা মতো শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেন এমন অভিযোগও পাওয়া যায়। এভাবে বর্তমানে শিক্ষা শ্রেণিকক্ষনির্ভর না হয়ে কোচিংনির্ভর হয়ে পড়ছে।

পরিসংখ্যান বলছে, কোচিং সেন্টারওয়ালা শিক্ষকগণ বছরে বত্রিশ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য করে থাকেন। যে কোনো মূল্যে শিক্ষাকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে না পারলে এ গুরুতর সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। মানসম্মত শিক্ষার প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে শ্রেণিকক্ষের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কেবল শ্রেণিকক্ষের ভৌত অবকাঠামো বাড়িয়ে এর গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এর জন্য দরকার মানসম্মত শিক্ষক। একজন ভালো শিক্ষক বটতলায় দাঁড়িয়ে ক্লাশ নিলেও তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসেও কমযোগ্য শিক্ষকের ক্লাশ শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করবে না।

গত এক দশকে সরকারের পক্ষ থেকে কারিকুলাম আধুনিকীকরণ, মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির প্রয়োগ, এ সম্পর্কিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির ব্যবহার, একাডেমি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পাঠদান পরিচালনা, শিক্ষার্থীর নিবন্ধন ও ফলাফল প্রদানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, সম্ভাব্য স্বল্প সময়ে ফলাফল প্রদান, শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিনে কোটি কোটি শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠ্যপুস্তক প্রদান শিক্ষাক্ষেত্রের অভিনব সাফল্য হিসেবে উল্লেখ করা যায়। অতীতের অনিহা, কুসংস্কার কাটিয়ে বর্তমানে শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের গভীর অনুরাগ ও আগ্রহ উল্লেখ করার মতো বিষয়। বিশেষ করে নারী শিক্ষার আগ্রহ ও যে প্রসার লক্ষ করা যায় তা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় প্রশংসাযোগ্য।

শিক্ষকগণ হচ্ছেন ‘সমাজ গড়ার কারিগর’। অধুনা তাদের অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন শব্দবন্ধ ‘সমাজ গড়ার শিল্পী’ অভিধায় অভিহিত করা হলেও এখনও শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা কম হওয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে অবলম্বন করছেন না। জীবননির্বাহের জন্য বেতন পর্যাপ্ত নয়; বিধায় অভাব পূরণের তাগিদে অধিকাংশ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষের শিক্ষায় মনোনিবেশ না করে প্রাইভেট, কোচিং-বাণিজ্য, কৃষিকাজ বা নানামুখী ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের শতভাগ সেবা থেকে বঞ্চিত থাকছে। শিক্ষকদের জীবনমানের প্রশ্নের সমাধান না করে কোচিং ও প্রাইভেটের বিরুদ্ধে নীতিমালা বা আইন প্রণয়ন করে কোনো সাফল্য আসবে না। মনে রাখতে হবে শিক্ষকগণই মানসম্মত শিক্ষার মূল অনুঘটক। শিক্ষক সমাজকে অবহেলিত ও বঞ্চিত রেখে শিক্ষার মানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। এটি বাংলাদেশের শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে গুরুতর বাধা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এ সমস্যা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত। এ সমস্যার রাতারাতি সমাধান হবে না। তবে প্রাথমিক স্তরে সবচেয়ে ভালো শিক্ষকদের দরকার সর্বাগ্রে; কেননা শিশুর ভবিষ্যৎ শিক্ষার ভীত তৈরী হয় এই স্তরে। এও স্বীকার্য যে, প্রাথমিক শিক্ষার মান মাধ্যমিককেও নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই দু’স্তরের শিক্ষার দুর্বলতা উচ্চ শিক্ষায় প্রভাব ফেলে। প্রাথমিক পর্যায়ে যোগ্যতাসম্পন্ন ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাব র্দীর্ঘদিনেও আমরা পূরণ করতে পারিনি। এ স্তরে বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীর চাপ, শিক্ষক স্বল্পতা ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের অভাবতো রয়েছেই। এক সময় গ্রামের শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষায় তুলনামূলকভাবে শহরের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো করতো। এখন তা হয় না; এর অন্যতম কারণ গ্রামের স্কুল-কলেজগুলোতে ভালো শিক্ষকের অভাব। বিশেষত ইংরেজি, গণিত এবং বিজ্ঞানের যোগ্য শিক্ষকের অভাব প্রকট।

আর্থিক অবস্থা ও যোগ্যতার পাশাপাশি শিক্ষকদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় মানসম্মত শিক্ষার পথে বাধা হিসেবে অনেক অভিভাবক চিহ্নিত করতে চান। তাঁদের অভিযোগ-বর্তমানে শিক্ষক হিসেবে যাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই অযোগ্য। শিক্ষার প্রতি তাঁদের অনুরাগ কম। এঁরা দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের আধুনিক চিন্তা-চেতনা, প্রযুক্তিকে উদারভাবে আলিঙ্গন করতে পারেন না। শ্রেণিকক্ষে যিনি বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন তিনি নিজেই বিজ্ঞানমনস্ক নন; ইতিহাসের শিক্ষকও ইতিহাসবিমুখ। প্রমিত মাতৃভাষা উচ্চারণেও অনেকে অক্ষম। শুধু সুযোগ-সুবিধা বা বেতনস্কেল বাড়িয়ে শিক্ষকদের এ অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের আর্কষণীয় বেতন কাঠামোর পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নির্দলীয়, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও দুনীতিমুক্ত যথাযথ নিয়োগ বা বাছাই পদ্ধতি অনুসরণ করা। বর্তমানকালে ছাত্র ও শিক্ষকের পারস্পরিক সম্পর্কও শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করা যায়। শিক্ষক সম্পর্কে ছাত্রের মনে যতটা না শ্রদ্ধা বা অনুরাগ তার চেয়েও বেশি ভীতি কাজ করে। বিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন শিশুদের প্রতি শিক্ষকের মানসিক নির্যাতন বা শারীরিক শাস্তি শিশুদেরকে বিদ্যালয় ও শিক্ষাবিমুখ করে তুলে বলে অভিভাবক ও বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, অভিভাবকদের মতামত গ্রহণকে গুরুত্ব না দেওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে চাইলে শিক্ষা সংক্রান্ত সিদ্বান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন বলে অভিভাবকগণ প্রত্যাশা করেন। বিশেষ করে বিদ্যালয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় শিশুর সক্রিয় অংশগ্রহণ একান্ত দরকার । প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে নতুন করে ভাবা যেতে পারে। এসব পরীক্ষা অল্প বয়সী শিশুদের ওপর অতিরিক্ত মানসিক চাপ, লেখাপড়ার প্রতি ভীতি আর অভিভাবকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে কি না? পৃথিবীর অন্যদেশগুলো যখন পাবলিক পরীক্ষা কমিয়ে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মূল্যায়নপদ্ধতি প্রচলন করছে তখন আমরা উল্টোরথে যাত্রা করছি কি না? ভেবে দেখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকার সংবিধান দ্বারা একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান ও নিরক্ষরতা দূরীকরণে বাধ্য। এটি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কর্তব্য। এই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সকল নাগরিককে উদ্যোগী ও উদ্যমী ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষার কেবল পরিসংখ্যান বা পরিমাণগত উন্নয়নকে গুরুত্ব দিলে হবে এর মানগত দিকটি বরং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।

ষাট গম্বুজ বার্তা
ষাট গম্বুজ বার্তা